Home Apparel নন-কটন ফ্যাব্রিকে এখন জরুরি বিপুল বিনিয়োগ

নন-কটন ফ্যাব্রিকে এখন জরুরি বিপুল বিনিয়োগ

বিশ্বব্যাপী ভোক্তারা মিশ্র সুতায় তৈরি পোশাক কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ায় দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ফ্যাশন বাণিজ্যের সাথে তাল মিলিয়ে, ম্যান মেইড বা কৃত্রিম ফাইবার উৎপাদনে জরুরি ভিত্তিতে বিপুল বিনিয়োগের তাগিদ অনুভব করছেন দেশের টেক্সটাইল উৎপাদকরা। 

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তুলা ভিত্তিক ফাইবার উৎপাদনে বেশি জোর দেওয়ায়, উভেন পোশাক প্রস্তুতকারকরা তাদের চাহিদার ৬০ শতাংশ শতাংশ নন-কটন ফাইবার আমদানির মাধ্যমে পূরণ করছেন। 

এব্যাপারে শীর্ষ স্থানীয় যেসব স্পিনিং মিল কৃত্রিম ফাইবার উৎপাদনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে, তাদের পরিচালকরা জানিয়েছেন, সিনথেটিক ফাইবার উৎপাদন ইউনিট স্থাপনে বিপুল বিনিয়োগের দরকার হওয়ায়- সরকারি নীতিগত সমর্থন প্রয়োজন, যা উভেন পোশাক রপ্তানিকারকদের পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সাহায্যের পাশাপাশি প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখবে।   

আপাতত, উন্নত বিদেশি কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগ, একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে বলেও তারা উল্লেখ করেছেন। এতে দেশে উচ্চ মূল্যের সুতা উৎপাদনের গবেষণাও নতুন গতি লাভ করবে।  

স্পিনাররা বলছেন, চাহিদার তুলনায় পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছে তাদের সরবরাহের পরিমাণ খুবই কম, কারণ এ ধরনের ফ্যাব্রিক উৎপাদনের অবকাঠামো স্থাপনে বড় অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা তারা সরাকারি নীতিগত সমর্থনের অভাবে নিতে পারছেন না।   

টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন- বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, দেশের রপ্তানিমুখী নিটওয়্যারের ৮০ শতাংশ ফ্রেবিক তারা সরবরাহ করলেও, উভেন পোশাকের মাত্র ৪০ শতাংশ কাঁচামাল- সুতা ও কাপড় স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো সরবরাহ করছে। 

বিটিএমএ’র তথ্য বলছে, ২০২০ সালে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টন নিটেড ও ৪ লাখ ২১ হাজার টন উভেন ফ্যাব্রিক আমদানি করেছে।

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “৮ থেকে ১০টি ধাপ থাকায় উভেন ফ্যাব্রিক (কাপড়) উৎপাদন খুবই জটিল। তাই মাঝারি মানের একটি উভেন টেক্সটাইল মিল স্থাপনেও ন্যূনতম ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের দরকার হয়। “

টেক্সটাইল মিলে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি করে তিনি বলেন, এখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা করা উচিত। 

বিটিএমএ সভাপতি আরও জানান, স্থানীয় টেক্সটাইল মিলাররা স্থানীয় বাজারের জন্য প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের কাপড় সরবরাহ করে। 

দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প স্থাপনে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।

“নতুন শিল্প শুরু করতে জয়েন্ট ভেঞ্চার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন উদ্যোগের ফলে আমরা নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যাপারে জ্ঞানলাভ করতে পারি, এবং এটি আমাদের নিজস্ব হওয়ায়- দিনশেষে পরনির্ভরশীলতাও কমায়।”  

বিজিএমইএ সহ-সভাপতি বলেন, এক সময় চীন, হংকং ও ভিয়েতনামের নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ দিতে আসতেন, কিন্তু এখন স্থানীয়রাই তাদের বদলে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। 

“বিশ্ববাজারে চীন প্রধান সরবরাহকারী হওয়ায়, বাংলাদেশকেও সেখান থেকে অ্যাকটিভ ওয়্যার ও উভেন ফ্যাব্রিক আমদানি করতে হয়। চীনের রয়েছে এ ধরনের ফ্যাব্রিক সবচেয়ে কম মূল্যে উৎপাদনের প্রতিযোগী সক্ষমতা। তবে সংক্ষিপ্ত লিডটাইমের মতো কিছু সুবিধার জন্য আমরা পোশাক রপ্তানিকারকরা যতটা পারি, দেশীয় ফ্যাব্রিক ব্যবহারের চেষ্টা করি,” যোগ করেন আজিম। 

এনিয়ে ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ফজলে শামীম এহসান মন্তব্য করেন, সরকার ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড উভয় শিল্পকে আকর্ষণীয় নীতি সহযোগিতা দিলে, নতুন বিনিয়োগ আসবে।  

তিনি বলেন, “কিছুক্ষেত্রে বায়ারদের পছন্দানুসারে আমাদের ফ্যাব্রিক আমদানি করতে হচ্ছে। ক্রেতারা একটি দেশে একই রকম পণ্যের বিপুল অর্ডার দিলে সবক্ষেত্রেই তাদের সমান মান নিশ্চিত করতে হয়, যেকারণে তারা স্থানীয় বাজারে একই রকমের ফ্যাব্রিক থাকলেও, তা বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির তাগিদ দেন।” 

বৈশ্বিক পর্যায়ে মিশ্র সুতার ব্যবহার বাড়তে থাকায়, স্পিনিং খাতের অনেক উদ্যোক্তা সম্প্রতি তুলা, পলেস্টার, নাইলন, উল ও ভিজকোজের মতো কাঁচামাল থেকে সুতা উৎপাদনে নতুন করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন। 

অনেক স্পিনিং মিল তাদের সক্ষমতার একাংশকে সিনথেটিক বা কৃত্রিম সুতা উৎপাদনে রূপান্তরের কাজ শুরু করেছে। 

এব্যাপারে বিটিএমএ পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজীব হায়দার মুন্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, অনেক স্পিনিং মিল তাদের সক্ষমতার একাংশকে সিনথেটিক বা কৃত্রিম সুতা উৎপাদনে রূপান্তরের কাজ শুরু করেছে। বেশ কিছু মিল সিনথেটিক ও মিশ্র সুতা উৎপাদনে নতুন ইউনিট স্থাপনেও বিনিয়োগ করছে।  

রাজীব হায়দার জানান, “পোশাক কারখানা মালিকদের তরফ থেকে সিনথেটিক ও মিশ্র সুতার ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিক্রিয়ায় মিল মালিকরা এমন উদ্যোগ নিচ্ছেন।”

এক বছরের মধ্যেই এসব সুতার উৎপাদন বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি । 

ম্যান মেইড ফাইবার বা কৃত্রিম তন্তু থেকে উৎপাদিত কাপড় বৈশ্বিক পোশাক বাজারের ৭৮ শতাংশ দখল করেছে, বাকী বাজারটি তুলা ভিত্তিক সুতায় উৎপাদিত পোশাকের।

ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার ফেডারেশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের রপ্তানি ৭০ শতাংশই তুলা ভিত্তিক পোশাক, আর বাকি অংশ সিনথেটিক ফাইবারে তৈরি। 

এ বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ স্পিনিং মিল ও টেক্সটাইল প্রস্তুতকারক- নোমান গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ এনামুল করিম জানান, বাংলাদেশের উভেন শিল্পে, বিশেষত সিনথেটিক সুতা উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।   

উভেন, নন-কটন এবং সিনথেটিক সুতা উৎপাদনে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশ- চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান। স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, ফাইবার, ডাই ও কেমিক্যালের সরবরাহ থাকায়, তারা বাংলাদেশের চাইতে বৈচিত্র্যমূলক পোশাক উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে। 

বাংলাদেশের সুবিধার জায়গা কেবল দুটি- জনশক্তি ও বিদ্যুৎ। 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “অন্যান্য টেক্সটাইল শিল্পের তুলনায় বড় আকারের বিনিয়োগ দরকার হওয়ায় আমরা ম্যান মেইড ফাইবার (এমএমএফ) উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছি।” 

“স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক ধরনের টেক্সটাইল শিল্পের কল্যাণে বাংলাদেশ ৭০ শতাংশ তুলা ভিত্তিক পোশাক পণ্য রপ্তানি করছে। কিন্তু, এখন নন-কটন বা কৃত্রিম সুতা উৎপাদনে বিনিয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যা আমাদের রপ্তানি পণ্যঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনবে এবং একইসাথে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। “

সরকারের কর অবকাশের গুরুত্ব উল্লেখ করে জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেন, সরকার নন-কটন ভিত্তিক পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিলে, এক বছরের মধ্যে তাদের বাজার অংশীদারিত্ব বেড়ে যাবে। তখন বাজার চাহিদার কথা মাথায় রেখে স্পিনিং মিল মালিকরাও নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন।

বিজিএমইএ সভাপতি মনে করেন, নতুন এমএমএফ পণ্যে সরকার ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিলে,  অতিরিক্ত ২০০ কোটি ডলার বার্ষিক রপ্তানি আয় বাড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here