পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ নিয়ে ইতিবাচক ধারণা তৈরির পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবনমান বদলে দিচ্ছে ইনক্লুসিভ বিজনেস বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা। এই উদ্যোগের ফলে শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকছেন, এতে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে এবং রপ্তানিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানান পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাঁরা বলেন, কারখানায় এই উদ্যোগ চালু থাকায় ইতিবাচক অভিজ্ঞতা পেয়েছেন তাঁরা। এর ফলে মাঝে মাঝে শ্রমিকদের কাজে না আসা এবং ছুটি নেওয়ার প্রবণতা অনেক কমেছে।
কয়েক বছর ধরে নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন সংস্থা এসএনভি ও ডাচ্-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিবিসিসিআই) যৌথভাবে ইনক্লুসিভ বিজনেসের কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশে। এরই মধ্যে কয়েকটি পাইলট প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছে তারা। এ উদ্যোগের অধীনে পোশাক শ্রমিকদের যেসব সেবা দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে পোশাক কারখানায় মুদি দোকান, নারীকর্মীদের সুলভে স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদান, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় নিয়মিত কাউন্সেলিং, পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ডাক্তারি সেবা, অনলাইন মেডিক্যাল ডায়াগনসিস সেবা, কম খরচে চক্ষু চিকিৎসা, কম মূল্যে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বিতরণ এবং নারীকর্মীদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা।
এই কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসএনভির আরএমজি ইনক্লুসিভ বিজনেস কর্মসূচির উপদেষ্টা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ইনক্লুসিভ বিজনেস মডেলের কারখানায় শ্রমিকের অনুপস্থিতির হার কমেছে। এতে উৎপাদন বেড়েছে, শ্রমিক-মালিক সব পক্ষই উপকৃত হচ্ছে।’ এই মডেলের ফলে একজন ভোক্তা কম দামে ভালো পণ্য পাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে উদ্যোক্তারা সেরা পণ্য সাশ্রয়ী দামে বিক্রি করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে। এতে কর্মীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্ত থাকায় কারখানায় উৎপাদন বাড়ছে।’ উদ্যোক্তা, কারখানা এবং দাতা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তৃণমূল থেকে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
অন্তর্ভুক্তিমূলক এই ব্যবসায় নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে কাজ করছে ইলাপ্যাড। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মামুন উর রহমান জানান, নারী পোশাক শ্রমিকদের সাশ্রয়ী দাম, পরিবেশবান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্যানিটেশন ন্যাপকিন সরবরাহ করেন তাঁরা। তাঁদের এই ন্যাপকিনের নাম ‘ইলা প্যাড’।
তিনি বলেন, ‘বাজার থেকে যারা ন্যাপকিন কিনে পরতে পারে না তাদের জন্য এই প্যাড। খুব কম দামে তারা এটা ব্যবহার করতে পারে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পুনরায় ব্যবহারের আগে ভালো করে রোদে শুকিয়ে বা ইস্ত্রি করে নিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘কিভাবে একটি প্যাড তৈরি করা হয়, বিষয়টি নিয়ে আমরা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকি।’
ডিবিসিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার শওকত আফসার বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সুস্বাস্থ্য এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স এবং ইউরোপের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ডের নাম শুনলে দেশের উদ্যোক্তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। একই সঙ্গে অনেকে গর্ব করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য। যার ফলে সবুজ কারখানার শীর্ষে এখন বাংলাদেশ।’
তৈরি পোশাক খাতের একটি কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইনক্লুসিভ বিজনেসের আওতায় তাঁদের কারখানার কর্মীদের ক্ষুদ্র বীমার আওতায় আনা হয়েছে। এতে সহায়তা করছে প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স। তিনি জানান, চার বছর আগে নেওয়া এমন একটি কর্মসূচি শেষ হয়েছে। আবারও নতুন করে শুরু হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় একজন শ্রমিক বছরে ১৫ হাজার টাকার বীমা সুবিধা পান। হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসায় তিন হাজার টাকার সুবিধা পান। ১২ হাজার টাকা পান অপারেশনসহ অন্য চিকিৎসার জন্য। স্বাস্থ্যসেবায় এমন সুবিধা পাওয়ায় বর্তমান কর্মসূচিগুলোতে শ্রমিকরা নিজেরাই বীমার প্রিমিয়ামের টাকা দিয়ে অংশীদার হচ্ছেন। আগে কারখানার মালিক, উদ্যোক্তা ও দাতা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বীমার টাকা পরিশোধ করেছে।
এসএনভি আরএমজি ইনক্লুসিভ বিজনেস কর্মসূচির টিম লিডার ফার্থিবা রাহাত খান বলেন, ‘এ কর্মসূচির আওতায় দেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মানসিক ও স্বাস্থ্য খাতের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এর ফলে কাজ থেকে হঠাৎ করে ছুটি নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। একসময় স্বাস্থ্য বীমায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ না থাকলেও বর্তমানে নিজেদের উদ্যোগেই তাঁরা স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আসছেন। একই সঙ্গে উদ্যোক্তারাও ধীরে ধীরে লাভবান হয়ে উঠছেন। বিভিন্ন খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় ১০টি প্রকল্পের কাজ চলছে।’