ফাস্ট ফ্যাশনের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে কিছু ব্র্যান্ড আর সেই ব্র্যান্ডের আড়ালের মানুষগুলোর পকেটে এসে ধরা দিয়েছে মিলিয়ন ডলার। পরিমিতিবোধের মাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে সীমাহীনতায়। একটি পোশাকের গড় আয়ুকাল কমছে তো কমছেই। বিশ্ব একটু একটু পরিণত হচ্ছে ফ্যাশন বর্জ্যের ভাগাড়ে। ক্রমশ বেড়ে চলেছে কার্বন। এসবের বিপরীতে আবার শুরু হয়েছে স্লো ফ্যাশন, ইকো ফ্রেন্ডলি ফ্যাশন, সীমিত পরিসরে আপসাইক্লিং আর রিসাইক্লিং, থ্রিফট শপ-এ রকম সব মুভমেন্ট। আলো ফেলা যাক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অম্লমধুর পরিপ্রেক্ষিত ও আমাদের কী করণীয়, সেদিকে।
পোশাক অপচয়ের অসুবিধা কোথায়
আপনি ভাবছেন, আপনার টাকায় আপনি ফ্যাশন করবেন। আপনি ফাস্ট ফ্যাশনে আগ্রহী। আপনার এক পোশাকের একটা ছবি সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করার পর আপনার আর সেটি পরতে ইচ্ছে করে না। তারকারা তো এক পোশাক দুবার পরলেই ‘খবর’ হয়ে যান! এভাবে ফাস্ট ফ্যাশনের ফ্যালাসিতে বুঁদ হয়ে পড়েছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি বেড়েছে হু হু করে। তাতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আছে। ফাইবার টু ফ্যাশন ডট কম এই বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পোশাক যে কাপড় দিয়ে তৈরি হয়, সেটি উৎপাদনে অনেক প্রাকৃতিক শক্তি, জায়গা আর পানি খরচ হয়। সুতি কাপড় বিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কাপড়গুলোর একটি। একটা সুতির টি-শার্ট বানাতে যে পরিমাণ কাপড় লাগে, সেটির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা উৎপাদন করতে ২০ হাজার লিটার পানি খরচ হয়। বিশ্বে যত পানি ব্যবহৃত হয়, তার শতকরা ২০ ভাগ খরচ হয়ে যায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। এর সঙ্গে রয়েছে এনার্জি-প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম। এসব দিয়ে উৎপাদিত পোশাক দ্রুতই বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। তা ল্যান্ডফিল করে, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ করে নানাভাবে পরিবেশদূষণে অবদান রাখছে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড রেসপনসিবল অ্যাক্রিডিটেড প্রোডাকশন (ডব্লিউআরএপি) জানাচ্ছে, প্রতিবছর যুক্তরাজ্যে ১৪০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার জামাকাপড় ফেলে দেওয়া হয়। আর সেগুলো কেবল ল্যান্ডফিল করে।বিজ্ঞাপন

ফেলে দেওয়া পোশাক কী হয়?
আমরা যখন কোনো জামাকাপড় ফেলে দিই, তখন আসলে কী হয়? এর উত্তর জানিয়ে ‘হোয়াই ক্লোদস আর হার্ড টু রিসাইকেল’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৩ শতাংশ পোশাক হয় পুড়িয়ে ফেলা হয়, নতুবা ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয় বা আবর্জনা হিসেবে ল্যান্ডফিলে জমা হয়। ১২ শতাংশ পোশাক ডাউনসাইকেলড হয়ে ম্যাট্রেস, ক্লিনিং ক্লোদস, পাপোশ, লুসনি বা অন্যান্য কম দামের নানা কিছুতে পরিণত হয়। শতকরা মাত্র ১ ভাগ আপসাইকেলড হয়ে নতুন কাপড়ে পরিণত হয়। প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কাপড় ফেলে দেওয়া হয়। বাংলাদেশি অর্থমূল্যে যার দাম দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে কম বর্জ্য উৎপাদন করা দেশের নাম জার্মানি। তারাও মাত্র ৫০ ভাগ ফেলে দেওয়া পোশাক রিসাইকেল করে নতুন পোশাক বানায়। কেবল ২০১৬ সালেই ১১ লাখ টন ফ্যাব্রিক নষ্ট হয়। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এর ৭৩ ভাগই প্রিকনজিউমার ওয়েস্ট। মানে, ওই পোশাকগুলো ভোক্তারা কেনেননি বা কিনলেও ব্যবহার করেননি। এমন পুরোনো অব্যবহৃত ফেব্রিকসের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ টন। এর কারণ ছিল ভোক্তাকে ‘আউট অব স্টক’ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, এ জন্য অনেক ব্র্যান্ডই ১০ শতাংশ পর্যন্ত উদ্বৃত্ত স্টক রাখে। তবে এখন বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু ব্র্যান্ড দাঁড়িয়ে গেছে, যারা টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছে।

গার্মেন্টস বর্জ্যের অ আ ক খ
বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন অনুসারে, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটা পর্যায়ে উৎপন্ন হয় বর্জ্য। স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং, ফিনিশিং, গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, পোস্ট কনজিউমিং-প্রতিটা ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয় বর্জ্য। সব মিলিয়ে এই সমস্ত বর্জ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রি-কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্ট, পোস্ট-কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্ট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেক্সটাইল ওয়েস্ট।
কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্ট বা ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর আগেই গার্মেন্টসের ভেতরে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার ভেতর রয়েছে ঝুট কাপড়, ত্রুটিপূর্ণ কাপড় বা পোশাকের নমুনা, ফ্যাব্রিকের আঁশ বা তন্তু, বাড়তি কাপড়সহ আরও নানা কিছু। গার্মেন্টস শিল্পে যে পরিমাণ কাপড় ব্যবহৃত হয় তার শতকরা ১৫ ভাগ প্রি-কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্ট হিসেবে বর্জ্যে পরিণত হয়। এই ধরনের বর্জ্য দিয়ে নানা কিছু বানিয়ে সেগুলোর উপযোগিতা সৃষ্টি করা যায়। যেমন, গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় দিয়ে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা মামুনুর রহমান বানাচ্ছেন এলা প্যাড। প্রাথমিকভাবে গার্মেন্টসের নারী কর্মীরা পিরিয়ডের সময় তাদেরই হাতে তৈরি ঝুট কাপড়ের প্যান্টি আর প্যাড ব্যবহার করে। এটাকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য কাজ করছেন এই উদ্যোক্তা। এ ছাড়া সিনথেটিক যে প্রি-কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্ট আছে, সেগুলো দিয়ে সাউন্ড প্রুফিং অ্যাপ্লিকেশনসহ আরও নানা কিছু বানানো যেতে পারে।

কোনো পোশাক আর গায়ে না ঢুকলে, পুরোনো হয়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, চলতি ফ্যাশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না চললে বা নিদেনপক্ষে ভোক্তার আর পরতে ইচ্ছে না করলে সেটা পোস্ট কনজিউমার টেক্সটাইল ওয়েস্টে পরিণত হয়। সেগুলোর একটা অংশ ফার্নিচার আর ঘর মোছার কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ফেলে দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আশি আর নব্বইয়ের দশকে বঙ্গবাজারে সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের বিশাল মার্কেট ছিল আর তা তুমুল জনপ্রিয় ছিল ভোক্তাদের মাঝে। তবে করোনাকালে এই ছুড়ে ফেলা পোশাকগুলো নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। অনেকেই সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড় আর পোশাক নিয়ে কাজ করছেন। বিশ্ব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতেও বেশ কিছু পোশাকের ব্র্যান্ড দাঁড়িয়ে গেছে যারা কেবল সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক নিয়ে কাজ করে। সেগুলোকে আপসাইক্লিং করে বিক্রি করে। ‘চল’ এমনই একটি বাংলাদেশি পোশাকের কোম্পানি। ইনস্টাগ্রামে ‘বাংলাদেশ থ্রিফট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা কেবল সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাক বিক্রি করে। সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাকের প্রতি মানুষের মনোভাব বদলালে, গ্রহণযোগ্যতা বাড়ালে গার্মেন্টস ওয়েস্ট অনেকটা কমে যাবে। আবার অনেক বহুজাতিক রিটেইল ব্র্যান্ড তাদের আউটলেটে সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক বিক্রি শুরু করেছে। অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেক্সটাইল ওয়েস্ট বলতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই যে পণ্যগুলোকে ‘আনফিট’ বা ‘বাতিল’ ঘোষণা করা হয়।
২০৫০ সালের মধ্যে ভোক্তার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। এই নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার অন্যতম সমাধানের নাম টেকসই ফ্যাশনশিল্প।

কেন চাই টেকসই ফ্যাশনশিল্প
খটমটে পরিসংখ্যান দিয়েই শুরু হোক। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) গবেষণা মতে, প্রতিবছর পোশাকশিল্প কারখানায় পোশাক ও তুলা ধোয়া ও রং করার কাজে ১ হাজার ৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহার করা হয়। কারখানাগুলো ব্যবহারের পর এই বিষাক্ত পানি নদী আর খালে ফেলে দেয়। ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ফ্যাশনশিল্পের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বর্জ্য নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে ভোক্তার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। এই নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার অন্যতম সমাধানের নাম টেকসই ফ্যাশনশিল্প।
কেবল ১৫ বছরে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। কাপড়ের দামও কমে চলে এসেছে মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। কাপড়ের দাম এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। আবার নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তের আয়ও বেড়েছে। সব মিলিয়ে একটা বড় শ্রেণি ১৫ বছর আগেও যে পরিমাণ পোশাক ব্যবহার করত, এখন করে তার দ্বিগুণ। ফলে এখন ফ্যাশন থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের পরিমাণও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আগে মানুষ একটা পোশাক যে পরিমাণ ব্যবহার করত, এখন তার শতকরা ৪০ ভাগও করে না। একটা পোশাকের গড় আয়ু দুই বছর দুই মাস। আর সেটি গড়ে ৭ থেকে ১০ বার পরা হয়।
অন্য রকম কিছু ব্র্যান্ডের কথা
দ্যা ফরোয়ার্ড ল্যাব দিয়েছে অন্যরকম এই ব্র্যান্ডগুলোর খোঁজ। প্যাটাগোনিয়া নামে একটি কোম্পানি আছে, যারা ভোক্তাদের ছেঁড়া বা পুরোনো পোশাক সেলাই করে নতুন করে দেয়। আবার কখনো কখনো ভোক্তাকে তার চাহিদা অনুযায়ী পুরোনো পোশাকের বদলে নতুন পোশাক দেয়। নুডি জিনস আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে মিলে ভোক্তাদের জিনস বিনা পয়সায় সেলাই করে পাঠিয়ে দেয়। ডিপপ গড়েই উঠেছে সেকেন্ড হ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে কেন্দ্র করে। ডিপপ পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে চ্যারিটি শপগুলোতে পাঠানোর বদলে সেগুলো নতুন করে তোলে। ভ্যালু যোগ করে। সেগুলো আবার নতুনের মতো বিক্রি হয়। দ্বিতীয়, তৃতীয়, এমনকি চতুর্থবারের মতোও জামাকাপড় নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় ডিপপে এসে। ফ্রেঞ্চ কোম্পানির মাইসনক্লেও আরেকটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। এর উদ্যোক্তা মা মেয়ে। তাঁরা জামাকাপড় সব হাতে সেলাই করেন। অন্যদিকে টিআরএমট্যাব নামের জুতার কোম্পানিটি পুরোনো জামাকাপড়, চামড়া দিয়ে জুতা বানায়। এতে ল্যান্ডফিলের পরিমাণ কমে।
বাংলাদেশেও এ ধরনের রিসাইক্লিং ও আপসাইক্লিং শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘চল’। এর পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি করছে নতুন আউটফিট।

আমরা করব কী
আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করি, যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বহুগুণ বেশি পোশাক উৎপাদন করা হয়। আর একবিংশ শতকে এসে গার্মেন্টসের জঞ্জালে ভরে উঠেছে পৃথিবী। চাপ পড়ছে তুলা উৎপাদন আর সুতার ওপর। বিশ্বে যত কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তার ১০ শতাংশের বেশি আসছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি থেকে। ফ্যাশন পলিউশন বা পোশাকের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ পরিবেশবাদীদের কপালের ভাঁজকে আরও গভীর করেছে। এমনিতেই বিশ্ব দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। আর সেখানে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। পরিবেশদূষণের যত কারণ, তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পোশাকশিল্প। ফাস্ট ফ্যাশনের ধারণা এই পরিবেশদূষণের মাত্রাকে গতিশীল করেছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ২০০০ সালে গড়ে দুটি কালেকশন বের করত।
একটি পোশাকের সর্বোচ্চ জীবনকাল গড়ে তিন বছর। পোশাক পুরোনো মলিন হয়ে যায়। ছিঁড়ে যায়। চলতি ট্রেন্ডের সঙ্গে যায় না। আপিন যদি একটা পোশাক ৯ মাস বেশি পরেন, তাহলেই ওই পোশাকের মাধ্যমে কার্বন উৎপাদন আর ওই পোশাকের পেছনে ব্যবহৃত পানির অপচয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
২০১১ সালে গড়ে পাঁচটি কালেকশনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ভোক্তাদের। এ ক্ষেত্রে ক্লোদিং ব্র্যান্ড জারা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা বছরে ২৪টি কালেকশন বের করে। এইচঅ্যান্ডএম ১২ থেকে ১৬টি কালেকশন বের করে। ফাস্ট ফ্যাশনের ফলে ওয়ার্ডরোব নতুন জামায় ভরে উঠছে। কিন্তু পৃথিবী হয়ে উঠছে বসবাসের অনুপযোগী। এমন অবস্থায় সাধারণ ভোক্তা হিসেবে আমাদের করণীয় থেকেই যায়।
ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ ভবিষ্যতের বিশ্বকে বাঁচাতে হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। প্রথমত, ‘গার্মেন্ট লাইফটাইম’ বাড়ানো। মানে এক পোশাক বেশি দিন পরা। পোশাকের আয়ু বাড়ানো। একটি পোশাকের সর্বোচ্চ জীবনকাল গড়ে তিন বছর। পোশাক পুরোনো মলিন হয়ে যায়। ছিঁড়ে যায়। চলতি ট্রেন্ডের সঙ্গে যায় না। আপিন যদি একটা পোশাক ৯ মাস বেশি পরেন, তাহলেই ওই পোশাকের মাধ্যমে কার্বন উৎপাদন আর ওই পোশাকের পেছনে ব্যবহৃত পানির অপচয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। যতটা সম্ভব কম পোশাক কিনুন। কোথাও ছিঁড়ে গেলে, ফেঁসে গেলে সেলাই বা রিফু করে নিন। আর পরতে ইচ্ছে না করলে বন্ধুদের সঙ্গে বদলে নিন। ১৯৮০-এর দশকে মানুষ যে পরিমাণ পোশাক কিনত, এখন তার পাঁচ গুণ পোশাক কেনে। ২০০০ সালে মানুষ যত পোশাক ভোগ করত, ২০১৪ সালে তার ৬০ শতাংশ বেশি পোশাক ভোগ করে। মনে রাখতে হবে আমরা যতটা পোশাক কিনি, মোটাদাগে ওই পোশাক তার আকৃতির সমান পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদিও এর নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে আরও নানা কিছু জড়িত।
পুরোনো পোশাকে ‘ভ্যালু অ্যাড’ করুন। টুকিটাকি এটা-সেটা করে ডিজাইন বদলে ফেলতে পারেন। শাড়ি দিয়ে গাউন বানান। শার্ট দিয়ে ব্লাউজ। ফুলপ্যান্ট কেটে হাফপ্যান্ট বানিয়ে নিতে পারেন। এগুলোর কিছুই করতে না পারলে বাসার সহকারীকে দিয়ে দিন। অথবা চ্যারিটি শপে দিন। সব মিলিয়ে পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করতে, পরিবেশদূষণ কমাতে জনপ্রিয় হচ্ছে রিসাইক্লিং। পুরোনো কাপড় রিসাইকেল করে হতে পারে অনেক কিছুই। পুরোনো জামাকাপড়, শার্ট দিয়ে বানিয়ে ফেলুন ট্রেন্ডি ব্লাউজ। সেটা আপনার শাড়ির লুকটাই বদলে দেবে। আর এই ছোট ছোট উদ্যোগ বদলে দেবে বিশ্ব।
পুরোনো কাপড় ভাগাড় বা সমুদ্রে না ফেলে বানিয়ে ফেলুন নতুন কিছু। সেটা হতে পারে আপনার মানিব্যাগ। একটা পুরোনো কামিজ, যেটা হয়তো আর গায়ে ঢুকছে না, সেটা মাঝখান থেকে কেটে ফেলুন। পছন্দসই লেস লাগিয়ে নিন। হুক বা বোতাম জুড়ে দিয়ে পরতে পারেন কটি হিসেবে। চাইলে বাদ দিতে পারেন হাতা দুটোকেও। আমাদের নানি-দাদিরা তো সুতি শাড়ি আর ওড়না দিয়ে কাঁথা বানাতে ওস্তাদ। রিসাইক্লিংয়ের সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ আমাদের কাঁথা। তাই ভেতরের দিকে বেশি পুরোনো কাপড়, আর ওপরের দিকে কম পুরোনো কাপড় আর একরঙা কাপড় দিয়ে মুড়ে যদি তার ওপর নকশা করেন, তাহলে তো কথাই নেই। এভাবে পুরোনো থেকেই হতে পারে নতুন কিছু। কয়েকটি পুরোনো কাপড় কেচে শুকিয়ে নতুন করে ডাই করে অথবা না করে বানিয়ে ফেলতে পারেন বর্ণিল ঝোলানো নকশা করা ব্যাগ। এ তো গেল ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমাদের করণীয়। টেকসই ফ্যাশনের কোনো বিকল্প নেই। এই ধরনের ইকো ফ্রেন্ডলি ব্র্যান্ড বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠতে হবে। সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাকের মার্কেটকে আরও বড় হতে হবে। সরকারিভাবেও পোশাকের মাধ্যমে দূষণ কমাতে নেওয়া যেতে পারে নানা উদ্যোগ। বিশেষ করে পোশাকশিল্পের মাধ্যমে পানিদূষণের বিকল্প পন্থা বাধ্যতামূলক করা অত্যন্ত জরুরি।