Home বাংলা নিউজ বাংলাদেশকে টপকাতে চেয়ে আরো পেছনে ভারত

বাংলাদেশকে টপকাতে চেয়ে আরো পেছনে ভারত

তৈরি পোশাক খাতের রফতানি বাড়াতে ২০১৬ সালে ৬ হাজার কোটি রুপির একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। ওই সময় প্যাকেজটির অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, তিন বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান দখল করতে চায় ভারত। তবে পাঁচ বছরেও এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি দেশটির তৈরি পোশাক খাত। বরং এ সময় দেশটির রফতানি আরো কমেছে। খোদ ভারত সরকারের পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, এ পাঁচ বছরে দেশটির তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ১২ শতাংশ বেড়েছে।

রফতানি বাড়াতে না পারলেও এ সময় তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেকটাই দৃঢ় হয়েছে ভারতের। খাতটির ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে আগে থেকেই বেশ শক্তিশালী ছিল ভারত। গত পাঁচ বছরে এ শক্তিমত্তা আরো বেড়েছে। এছাড়া দেশটিতে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো নিবেদিত উৎপাদনক্ষেত্রও আছে শতাধিক। কিন্তু এত সক্ষমতার প্রতিফলন এখন পর্যন্ত রফতানিতে দেখাতে পারেনি ভারত। শক্ত প্রতিযোগী হয়েও পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারছে না দেশটি।

বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে ভারতের পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১ হাজার ৭৩৮ কোটি ডলার। একই অর্থবছর বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয় ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলারের। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের। যেখানে ভারতের রফতানি ছিল ১ হাজার ২২৮ কোটি ডলারের। সে হিসেবে পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে ভারতের কমেছে ২৯ শতাংশ। বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে ভারতের রফতানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরে।

তবে এ পরিসংখ্যান সন্তুষ্ট করতে পারছে না ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, শুধু রফতানির অর্থমূল্য হিসাবে নিলে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। ভারতের পক্ষে এখনই এ দূরত্ব মোচন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এ রফতানি মূল্যের খুব স্বল্প অংশই ধরে রাখতে পারেন। দেশে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালের অর্ধেকেরও বেশি এখনো আমদানি করতে হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ভারত ব্যাকওয়ার্ড-ফরওয়ার্ড লিংকেজে যতটা এগিয়েছে, ততটা বাংলাদেশ এগোতে পারেনি। এক্ষেত্রে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজে উন্নতির পাশাপাশি সরকারের নীতি ও নগদ সহায়তারও প্রয়োজন পড়বে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চট্টগ্রামভিত্তিক ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের নীতিসহায়তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দুর্বল। অন্যদিকে ভারত, চীনে নীতিসহায়তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। আমরা বলি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এ ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা নীতি গ্রহণ করছি কি? আমাদের ব্যাংক আমাদের চাপে ফেলছে। ঝুঁকি নিয়ে ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন পোশাক রফতানিকারকরা। বর্তমানে আমরা ব্রেক ইভেনে কাজ করছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই অনেক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাবে।

ভারত ছাড়াও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকে রয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। চলমান কভিড সংকটে এসব দেশের রফতানিকারকরা মোটামুটি সবাই বেশ বিপাকে পড়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরাও বলছেন, চলমান সংকটে যে দেশ মূল্য সুবিধার পাশাপাশি ভালো মান ও সময়মতো (লিড টাইম) রফতানি করতে পারবে, সে দেশ ততই ভালো করবে। এ বিষয়টিই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

তারা বলছেন, বাংলাদেশে সরকারের দেয়া প্রণোদনা সুবিধাগুলো প্রশংসনীয় হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো অনেকভাবেই এগিয়ে। ভারতে ব্যাংকঋণের সুদ বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। প্রতিযোগী দেশের রফতানিকারকদের তুলনায় বাংলাদেশে লিডটাইমও অনেক বেশি। আবার উৎপাদন দক্ষতার দিক থেকেও ভারত এগিয়ে।

দেশটিতে তৈরি পোশাক রফতানিতে উন্নতির জন্য বিভিন্ন সময়েই এমন অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ভারত। দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, স্কিম ফর ইন্টিগ্রেটেড টেক্সটাইল পার্কস (এসআইটিপি) পরিকল্পনার অধীনে এখন পর্যন্ত ৫৯টি টেক্সটাইল পার্ক নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২২টির এরই মধ্যে নির্মাণ শেষ হয়েছে। এছাড়া তিন বছরের মধ্যে আরো সাতটি মেগা টেক্সটাইল পার্ক নির্মাণ করা হবে।

শক্তিশালী অবকাঠামো ও নীতিসহায়তা ভারতকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশটির রফতানিকারকরা পোশাক রফতানিতে যেমন প্রণোদনা পান, আবার সুতা রফতানির ক্ষেত্রেও পান। সব প্রণোদনাই মূলত নগদ সহায়তা। শুরুর দিকে ২০ শতাংশ থাকলেও পরে ১২ শতাংশ করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের নতুন বাজারে রফতানি, দেশীয় সুতা ব্যবহার ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য আছে ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা। সমস্যা হলো এসব সুবিধার পুরোটা পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, ভারতের সবচেয়ে বড় সক্ষমতার ক্ষেত্রটি হলো তুলা উৎপাদন। আবার কৃত্রিম সুতা সক্ষমতাও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। এ সুতা উৎপাদন বাংলাদেশেও হয়, কিন্তু দাম ভারতের চেয়ে বেশি। ভারত আমাদের কাছে খুব একটা ভয়ের কারণ এমনটা না। আমাদের শঙ্কার কারণ অন্য কোনো দেশ না, আমাদের শঙ্কার মূল ক্ষেত্রটি হলো আমাদের জাতীয় নীতি ও এর বাস্তবায়ন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মতবিরোধ ও সমন্বয়হীনতা।

এছাড়া বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে তৈরি পোশাক খাতের অভ্যন্তরীণ বাজারও বেশ শক্তিশালী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই তৈরি পোশাক খাতের সক্ষমতার প্রায় পূর্ণ ব্যবহার হয়ে যায়। এছাড়া শ্রম ও শ্রমিকের নিরাপত্তা কমপ্লায়েন্স ইস্যুতেও বাংলাদেশ এগিয়ে। এ কারণে বড় ক্রেতারাও বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহী।

বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমান পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, ভারত ভবিষ্যতে রফতানির দিকে আরো নজর দেবে। বাংলাদেশে কাঁচামাল রফতানিতে শুল্কারোপ করবে। দেশটি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে। আবার ফ্যাশন ডিজাইনের মতো ক্ষেত্রগুলোতেও নজর দিচ্ছে দেশটি। ফলে হাইএন্ড পণ্যের বাজারে দেশটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আবার দেশটিতে এরই মধ্যে ১৪০টির মতো অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে, যেগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল সক্রিয় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভারত বর্তমানে রফতানিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। ফলে উৎপাদকরা স্থানীয় বাজার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের বাজার সুবিধাগুলো যখন থাকবে না তখন বেশি সমস্যায় পড়ব। ফলে আমাদের উচিত বাজার সুবিধাভিত্তিক সক্ষমতা বা প্রতিযোগিতা থেকে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতানির্ভর সক্ষমতা বা প্রতিযোগিতার দিকে গুরুত্ব দেয়া। এ রূপান্তরই আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জ।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি উভয় দেশের জন্যই সমান লাভজনক বলে মনে করছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভারতের অর্থনীতিবিদরা গবেষণা করে দেখেছেন, দেশটি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো না করার অন্যতম কারণ হলো দেশটির কঠোর শ্রম আইন। এ কারণে দেশটির উদ্যোক্তারা ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ শক্তিশালী করতে বেশি সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রসর হতে পারেনি। ভারতও দেখছে, তাদের তুলা-সুতার গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আর সেটাতেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এখানে পরিস্থিতি দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক। তবে বর্তমানে মেক ইন ইন্ডিয়া নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে অনেক সময় নেবে। ভারতে শ্রমিকের দরকষাকষির সক্ষমতাও অনেক কমেছে। আজ ভারত রফতানি বেশি না করলেও ভবিষ্যতে যে পারবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ প্রযুক্তিগত বা অন্যান্য সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভারতের আছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here