Home Apparel সংশোধিত শ্রম বিধিমালায় শ্রমিকের সুবিধা কমছে

সংশোধিত শ্রম বিধিমালায় শ্রমিকের সুবিধা কমছে

নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা কমানো হয়েছে। চাকরির বয়স ৯ মাস না হলে বিমাসুবিধা পাবেন না পোশাকশ্রমিকেরা।

শ্রম বিধিমালা-২০১৫ সংশোধনের মাধ্যমে ‘যুগোপযোগী ও আধুনিকীকরণ’ করতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রস্তাব প্রণয়নে কমিটি গঠন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ৩৪ মাস পর সেই বিধিমালা সংশোধনের কাজ শেষ হয়। সেখানে নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন সুবিধা হিসাব করার নতুন নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে। এতে নারী শ্রমিকেরা আগের চেয়ে সুবিধা কম পাবেন। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা চাকরির বয়স ৯ মাস না হওয়া পর্যন্ত কল্যাণ তহবিল থেকে সুবিধা পাবেন না। এত দিন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অসুস্থতার কারণে নতুন-পুরোনো সব শ্রমিকই তহবিল থেকে সুবিধা পেতেন।

শ্রম বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বিধিমালায় বেশ কিছু ভালো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তবে দু-তিনটি জায়গায় শ্রমিকেরা এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিলেন, সেগুলো কাটছাঁট করা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে, নতুন নিয়মের মাধ্যমে নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন সুবিধা আগের চেয়ে হ্রাস করা, এটা অমানবিক ও অযৌক্তিক।

২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন প্রণয়ন করে শ্রম মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালে শ্রম আইনের ব্যাপক সংশোধন হয়। আইনের প্রয়োগ সহজ করতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। ২০১৮ সালে আরেক দফা শ্রম আইন সংশোধিত হয়। এরপর বিধিমালাও সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। গত ২৫ আগস্ট সংশোধিত শ্রম বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এতে ১০১টি বিধি সংশোধন করা হয়।

দেশে অনেক শিল্প খাত থাকলেও তৈরি পোশাকশিল্পের নেতারা শ্রম আইন ও বিধিমালায় যা চান, সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকনেতাদের দাবিদাওয়া শোনা হলেও পরে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এটি খুবই দুঃখজনক।

নাজমা আক্তার, শ্রমিকনেত্রী

মাতৃত্বকালীন সুবিধা

সরকারি নারী কর্মচারীরা ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান (বেতনসহ)। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও সেটি অনুসরণ করা হয়। তবে শ্রম আইন অনুযায়ী, বেসরকারি শিল্প খাতের নারী শ্রমিকেরা সন্তান জন্মের আগে ও পরে আট সপ্তাহ করে ১৬ সপ্তাহ বা চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। একই সঙ্গে মাতৃত্বকালীন সুবিধার বিষয়টি কীভাবে নির্ধারণ করতে হবে, তা–ও বলা রয়েছে। ছুটিতে যাওয়ার আগের তিন মাসের মোট মজুরিকে মোট কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করে যে গড় মজুরি বের হবে, সেই হারে চার মাসের মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবেন নারীরা। সেটাই পাচ্ছিলেন নারী শ্রমিকেরা।

অবশ্য সংশোধিত শ্রম বিধিমালায় মাতৃত্বকালীন সুবিধা হিসাব করতে নতুন উপবিধি যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ছুটির আগের মাসের প্রাপ্ত মোট মজুরিকে ২৬ (সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে এক মাস) দিয়ে ভাগ করে এক দিনের গড় মজুরির হিসাবে মাতৃত্বকালীন সুবিধা দিতে হবে। নতুন এই নিয়মের কারণেই নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন সুবিধা কমবে। আবার নির্ধারিত তারিখের পরে সন্তান প্রসব হলে সেই সময় পরবর্তী আট সপ্তাহের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় হবে। তবে সন্তান আগে হলে কী হবে, তা সংশোধিত বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়নি।

এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, গর্ভধারণের সাত মাস পর থেকেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় শ্রমিকদের। ওভারটাইমও অনেক সময় করতে পারেন না তাঁরা। সে জন্য তাঁদের মোট মজুরি কমে যায়। ফলে নতুন নিয়মে তাঁদের মাতৃত্বকালীন সুবিধাও কমবে। এটি অমানবিক। তিনি আরও বলেন, বিধিমালা কখনোই মূল আইনকে অস্বীকার করতে পারে না, তাই সংশোধিত বিধিমালায় যা করা হয়েছে, তা বেআইনি।

বিমা সুবিধা

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গোষ্ঠী বিমা বাধ্যতামূলক নয়। তার বিকল্প হিসেবে কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। সেই তহবিলের সুবিধাভোগী কল্যাণ ও আপত্কালীন নামে দুটি হিসাব রয়েছে। সুবিধাভোগী কল্যাণ হিসাব থেকেই কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সুবিধা এবং অসুস্থ শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়া হয়। আর তহবিলের জন্য পোশাক রপ্তানির প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে প্রাপ্ত মোট অর্থের দশমিক ০৩ শতাংশ অর্থ কারখানা মালিকেরা জমা দেন।

অবশ্য সংশোধিত বিধিমালায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় তহবিলের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বয়স ৯ মাস না হলে শ্রমিকেরা সুবিধা পাবেন না। তার মানে চাকরিতে যোগদানের ৯ মাসের আগে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে বা কেউ অসুস্থ হলে তাঁর আর্থিক সুবিধা অনিশ্চিত হয়ে গেল।

 এ বিষয়ে শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, দেশে অনেক শিল্প খাত থাকলেও তৈরি পোশাকশিল্পের নেতারা শ্রম আইন ও বিধিমালায় যা চান, সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকনেতাদের দাবিদাওয়া শোনা হলেও পরে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এটি খুবই দুঃখজনক।

যৌন হয়রানি

এদিকে সংশোধিত শ্রম বিধিমালায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে একজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে গণ্য করো হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৫ সদস্যের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে অভিযোগ কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যার প্রধান হবেন একজন নারী। এ ছাড়া কমিটিতে বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। তাঁরা সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মী।

এ বিষয়ে রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, যৌন হয়রানিবিষয়ক অভিযোগ কমিটির সব সদস্য যখন প্রতিষ্ঠানেরই হবেন, তখন সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হবে না। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল, সেটা হলো কমিটিতে প্রতিষ্ঠানের বাইরের একজন নিরপেক্ষ সদস্য রাখতে হবে। সংশোধিত বিধিমালায় উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনা রাখা হয়নি।

ইতিবাচক দিক

সংশোধিত বিধিমালায় বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয়ও রয়েছে। যেমন যেসব খাতে সরকার নির্ধারিত নিম্নতম মজুরি নেই, সেই সব খাতের শ্রমিকের মূল মজুরি হবে মোট মজুরির অর্ধেক। আর তাঁদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির হার কোনোভাবেই মূল মজুরির ৫ শতাংশের কম হবে না। আবার রাতের শিফটে কাজের ক্ষেত্রে আগে বছরে একবার নারী শ্রমিকদের মতামত নিতে হয়। এখন থেকে প্রতি মাসে এ বিষয়ে নারী শ্রমিকের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের নিয়ম অযৌক্তিক ছিল। সে কারণে আমরা ছুটির আগের মাসে মোট নির্ধারিত মজুরিকে ৩০ দিয়ে ভাগ করে গড় মজুরির হিসাবে মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। এতে সব শ্রমিকই সমহারে সুবিধা পাবেন।

তবে শেষ পর্যন্ত যা করা হয়েছে, তাতে অনেকে কম পাবেন, আবার অনেকে বেশি পাবেন।’ চাকরির বয়স ৯ মাসের কম—এমন শ্রমিকের কল্যাণ তহবিলের সুবিধা না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন কোনো প্রস্তাব ছিল না। এটি শ্রম মন্ত্রণালয় নিজেরাই করেছে।’

সংশোধিত শ্রম আইনটি কেমন হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান বলেন, দু-একটি জায়গা ছাড়া সংশোধিত বিধিমালায় শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়েছে। মাতৃত্বকালীন সুবিধা কমানো ও ৯ মাসের পর শ্রমিকের বিমাসুবিধা কার্যকরের বিষয়টি বিধিমালার বড় দুর্বলতা।

এ বিষয়ে শ্রমসচিব মো. এহছানে এলাহীর বক্তব্য নিতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here