Home Apparel নতুন নিয়োগ বন্ধ, অতিরিক্ত কাজও নেই

নতুন নিয়োগ বন্ধ, অতিরিক্ত কাজও নেই

কারখানাগুলো সক্ষমতার ৫০–৭৫ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথেও হেঁটেছে কোনো কোনো কারখানা। 

আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় আল্পস অ্যাপারেলসে প্রায় এক হাজার কর্মী নিট পোশাক উৎপাদন করেন। গত দুই মাসে নতুন কোনো ক্রয়াদেশ আসেনি। ফলে আগামী ডিসেম্বরের পর কারখানাটিতে উৎপাদন চালানোর মতো কাজ নেই।

এমনকি উৎপাদনসক্ষমতার চেয়ে ক্রয়াদেশ কম থাকায় দুই মাস ধরে শ্রমিকদের ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কাজও বন্ধ করে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এখন কোনো শ্রমিক চাকরি ছেড়ে চলে গেলে তাঁর কোনো স্থলাভিষিক্তও করা হচ্ছে না।

বিষয়টি নিশ্চিত করে আল্পস অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খান মনিরুল আলম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আমাদের কারখানায় ভরপুর কাজ থাকে।

তবে চলতি বছর একেবারেই ভিন্ন চিত্র।’ আল্পসের পাশেই তাঁর আরেকটি কারখানা আছে। ফ্যাশন ডট কম নামের শার্ট তৈরির ওই কারখানায় কাজ করেন দুই হাজার কর্মী। জানুয়ারির পর সেই কারখানায়ও ক্রয়াদেশ নেই বলে জানালেন তিনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের ক্রয়াদেশ দিতে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিলম্ব করেছে। সেই ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে। আগামী ১৫-২০ দিন তা আসবে। এই সময়ের মধ্যে ভালো ক্রয়াদেশ না এলে সামনে পোশাকশিল্পের জন্য মহাবিপদ আছে। 

ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ 

এই প্রতিষ্ঠান দুটির মতো রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের অধিকাংশ কারখানায় ক্রয়াদেশের পরিমাণ কম। ফলে উৎপাদনসক্ষমতার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না কারখানাগুলো। এ অবস্থায় ব্যয় কমাতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ ও নতুন নিয়োগ বন্ধ এবং সাপ্তাহিক ছুটি বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কারখানাগুলো। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথেও হেঁটেছে কোনো কোনো কারখানা।

পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেখানকার মানুষ গাড়ির জন্য জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাতে গুদামে পণ্যের মজুত বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ দেওয়া কমিয়ে দেয়।

ক্রয়াদেশের পণ্য প্রস্তুত হওয়ার পর জাহাজীকরণের অনুমতি দিচ্ছে না কোনো কোনো ক্রেতা। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে পণ্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। খরচ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত কাজ, নিয়োগ বন্ধসহ নানা উদ্যোগে টিকে থাকার চেষ্টা চলছে। তবে সংকট যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই ছাড়া বিকল্প থাকবে না।

ক্রয়াদেশ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম আসছে, এমন তথ্য দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ থেকে ক্রয়াদেশ আসার হার খুবই খারাপ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। অনেক কারখানা মালিককেই ঋণ করে শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে। এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ–সংকট নিরসনে সরকারের বেশি জোর দেওয়া উচিত। যাতে করে যখন ক্রয়াদেশ আসবে, তখন যেন আমাদের তা নেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকে।’

করোনার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তৈরি পোশাকের রপ্তানি। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এ সময় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও রপ্তানি ভালো ছিল। তবে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি সাড়ে সাত শতাংশ কমে যায়। ওই মাসে রপ্তানি হয় ৩১৬ কোটি ডলারের পোশাক। যদিও অক্টোবরে পোশাক রপ্তানিতে ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ক্রয়াদেশের অভাবে আমার নিজের কারখানার উৎপাদনসক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে গত দুই মাসে ১৫ শতাংশ শ্রমিককে বাদ দিতে হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, চলমান সংকটে গত দুই মাসে কিছু কারখানা ৫ থেকে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে।

চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় মাস দুয়েক আগেও শ্রমিকদের দিনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ হতো। সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতেই মূলত শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। তাতে শ্রমিকদেরও বাড়তি আয় হয়। তবে ক্রয়াদেশ কম থাকায় দেড় থেকে দুই মাস ধরে বেশির ভাগ পোশাক কারখানায় অতিরিক্ত কাজ বন্ধ রয়েছে। ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের অন্তত ১০ শতাংশ কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছে বলে জানালেন বিজিএমইএর নেতারা।

ক্লিফটন গ্রুপের একটি কারখানা চলতি মাস থেকে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করেছে। ক্লিফটন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় ও শ্রমিক ধরে রাখতে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।

এদিকে সব কারখানা যে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। তেমনই একটি কারখানা সাভারের এনআর ক্রিয়েশন। কারখানাটিতে কাজ করেন ৬৩৫ শ্রমিক। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও চেক রিপাবলিকের কয়েকটি ব্র্যান্ডের জন্য নিট পোশাক তৈরি করে তারা। জানুয়ারি পর্যন্ত কারখানাটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনের জন্য ক্রয়াদেশ আছে। ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদন চালানোর মতো কিছু ক্রয়াদেশ তারা ইতিমধ্যে পেয়েছে।

জানতে চাইলে এনআর ক্রিয়েশনের স্বত্বাধিকারী আলকাছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রয়াদেশ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা আপাতত নেই। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে কাপড় ডায়িং করতে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।’

গ্যাস–সংকটের কারণে বস্ত্র খাতের ৯০ শতাংশ কারখানা ভুগছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় কারখানাগুলো গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে তাদের উৎপাদনক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোনো শ্রমিক চাকরি ছাড়লে সেখানে নতুন করে নিয়োগ দিচ্ছে না বস্ত্রকলগুলো।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের ক্রয়াদেশ দিতে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিলম্ব করেছে। সেই ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে। আগামী ১৫-২০ দিন তা আসবে।

এই সময়ের মধ্যে ভালো ক্রয়াদেশ না এলে সামনে পোশাকশিল্পের জন্য মহাবিপদ আছে। তিনি আরও বলেন, ‘করোনার তুলনায় চলমান সংকটের প্রকটতা বেশি। মহামারির সময় দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সংকটের সমাধান কবে, সেটি আমরা কেউ জানি না।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here