Home বাংলা নিউজ ইন্ডাস্ট্রিতে গ্যাস শক…

ইন্ডাস্ট্রিতে গ্যাস শক…

শিল্পপতিরা বলছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার-সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিল্পোদ্যোক্তাদের কেউ কেউ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য বাড়তি মূল্য দিতে ইচ্ছুক থাকলেও, তারা এত বিশাল মূল্যবৃদ্ধি আশা করেননি।

ইনফোগ্রাফ: টিবিএস

ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া ও রাজস্ব ঘাটতি কমানোর উদ্দেশ্যে বুধবার (১৮ জানুয়ারি) গ্যাসের দাম অতি উচ্চ হারে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার।

ব্যাপক এই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা শিল্পপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে, যেহেতু বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কয়েকদিন পরই এলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা।

মাত্র ছয় দিনের ব্যবধানে এনিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো গণশুনানি ছাড়াই গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য সরকার তার সদ্য মঞ্জুর করা নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ করল। এই নির্বাহী আদেশের ফলে সরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখতিয়ারকে পাশ কাটিয়ে সব ধরনের জ্বালানির দাম ঠিক করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ-এর ৫ দিনের ঢাকা সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশ গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিল।

গত বছরের নভেম্বরে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সাথে এক বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেছিলেন যে, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটি তাদের গ্যাসের ওপর ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে।

ওই সময়ে নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন যে, ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি আইএমএফ গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শর্তও দিয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের আগে এবিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।

যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করা হচ্ছে

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এক ব্যাখ্যায় বলেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, “বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ্বালানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ্বালানির মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

ব্যাখ্যায় বলা হয়, চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করে পূরণ করতে হবে। ‘সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে’।

তবে গৃহস্থালি, সিএনজি, চা-শিল্প (চা-বাগান) ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। নতুন সমন্বিত মূল্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করা হবে।

ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য উদ্বেগের

বিশেষ করে পশ্চিমে— যা কিনা বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের বেশি রপ্তানিপণ্যের গন্তব্য—উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মন্দার আশঙ্কার সময় এই মূল্যবৃদ্ধিকে ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা ‘কল্পনাপ্রসূত’ ও বড় ধাক্কা বলে অভিহিত করেছেন।

বুধবার সরকারের জারি করা এক গ্যাজেট প্রজ্ঞাপন অনুসারে, নতুন নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় ওয়েটেড দাম দাঁড়ায় ২১.২৭ টাকা, যা গত বছরের জুনের ১১.৯১ টাকার প্রায় দ্বিগুণ।

১৭৯ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ ও ১৫৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং গ্যাস ব্যবহারকারী বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পগুলোকে লোকসানের ধাক্কা সইতে হবে। এখন থেকে ক্ষুদ্র, কুটির ও অন্যান্য শিল্পকে গ্যাস ব্যবহারের জন্য ১৭৮ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে।

নতুন মূল্যের ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলেছে, এ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় করতে তারা মূল্যবৃদ্ধি করেছে।

এর আগে গত ১২ জানুয়ারি সরকার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের মূল্য ৭.৪৯ টাকা ঘোষণা করে।

সর্বশেষ উদ্যোগের পর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৫.০২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা (১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি) করা হলো।

এছাড়া ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা (৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি) হয়েছে। আর বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে এই দাম ১১.৯৮ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা (১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি) হয়েছে।

মাঝারি শিল্পের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের নতুন দাম ১১.৭৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা (১৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি)। আর হোটেল-রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য হবে ৩০.৫০ টাকা, যেখানে এতদিন দাম ছিল ২৬.৬৪ টাকা (১৪ শতাংশ বৃদ্ধি)।

বুধবার (১৮ জানুয়ারি) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন দাম আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।

তবে গৃহস্থালি, সিএনজি, চা-শিল্প (চা-বাগান) ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জুনে খুচরা পর্যায়ের গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের দাম গড়ে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

‘ভিত্তিহীন’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মতপ্রকাশ করেছেন, গ্যাসের নতুন মূল্য ভর্তুকির চাপ দূর করেছে, তবে পদক্ষেপটা সরকারের জন্য লাভজনকও ছিল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ম তামিম নতুন এই দামকে খুব বেশি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার কীসের ভিত্তিতে এই দাম ঠিক করেছে, তা আমি বুঝতে পারছি না।’

ম তামিম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় মোট চাহিদার মাত্র ১৬ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পায়। বাকি চাহিদা স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো পূরণ করে।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এই সামান্য পরিমাণ এলএনজির জন্য সরকারের এমন রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ল কেন? সরকার গ্যাস বিক্রি থেকে কতটা লাভ করতে চায়?’

তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাস সরবরাহ একটি ইউটিলিটি পরিষেবা, এটা লাভের জন্য নয়। সরকার এই অকল্পনীয় মূল্যবৃদ্ধি না করে সামান্য দাম বাড়াতে পারত।’

দেশে মোট বিদ্যুতের প্রায় ৫৫ শতাংশ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ম তামিম বলেন, প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৫.০২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করার ফলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয় খরচ ইউনিটপ্রতি ২ টাকা বাড়বে।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি ফয়সাল খান বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব আইপিপিগুলোতে (বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়) পড়বে না।

তিনি বলেন, ‘গ্যাস কোম্পানিগুলোকে গ্যাসের বাড়তি দাম দিতে হবে পিডিবিকে, কাজেই বিদ্যুতের সামগ্রিক দাম বাড়বে।’

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, গ্যাসের ব্যবহার গত অর্থবছরের মতোই থাকলে নতুন মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকার বছরে ২৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারবে।

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট গ্যাস বিক্রি ছিল ২৮ হাজার ৬৬৭.৯২ মিলিয়ন ঘনমিটার।

একই পরিমাণ গ্যাস নতুন দামে বাজারজাত করা হলে মোট আয় হবে প্রায় ৬০ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা।

একটি বড় ধাক্কা

শিল্পপতিরা বলছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার-সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিল্পোদ্যোক্তাদের কেউ কেউ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য বাড়তি মূল্য দিতে ইচ্ছুক থাকলেও, তারা এত বিশাল মূল্যবৃদ্ধি আশা করেননি।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরপরই আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ভীষণ ধাক্কা খেয়েছি।’

আনোয়ার গ্রুপের সিমেন্ট, ইস্পাত ও টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবসা আছে—যার প্রতিটাই গ্যাস-নির্ভর।

ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি খুব ‘সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নয়’।

গ্যাস ব্যবহারকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্লাস্টিক ও সিরামিকস উৎপাদনের ব্যবসা রয়েছে আজম জে চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তারা সম্প্রতি সরকারকে চিঠি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হলে বাড়তি মূল্য দিতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন।

‘কিন্তু বর্তমান সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিল্প টিকে থাকতে পারবে না’—সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এমনটাই বলেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একলাফে গ্যাসের দাম এতটা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রভাব পড়বে ভোক্তা ও উৎপাদকদের ওপর। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগী-সক্ষমতারও ক্ষয় হবে।

গতবছরের আইএমএফ এর এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে ভর্তুকির বিষয়ে বলা হয়েছে, জ্বালানির দাম তাদের প্রকৃত খরচের অন্তত ৫০ শতাংশ কম রাখতে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যা কয়লার জন্য ৯৯ শতাংশ, ডিজেলের জন্য ৫২ শতাংশ এবং গ্যাসের জন্য ৪৭ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি দেশ – চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত এবং জাপান – ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ভর্তুকির দুই-তৃতীয়াংশ দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here