Home বাংলা নিউজ আমেরিকায় বাংলাদেশের একটি পোশাক বিক্রি হয় ১০০ ডলারে, শ্রমিকের মাসিক বেতন তারও...

আমেরিকায় বাংলাদেশের একটি পোশাক বিক্রি হয় ১০০ ডলারে, শ্রমিকের মাসিক বেতন তারও কম

২৮ বছর বয়সী নাইম প্রামাণিক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশ্রমিক। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে বেকার হয়ে পড়েছেন তিনি। সম্প্রতি তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, তিনি ন্যায্য মজুরি দাবি করেছিলেন।

নাইমের মতো বাংলাদেশের লাখো গার্মেন্টস শ্রমিক দীর্ঘ এক দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর জন্য দ্রুত ও দক্ষ হাতে পোশাক তৈরি করে যাচ্ছেন। টমি হিলফিগার ও জর্জ ব্র্যান্ডের পোশাক দেখিয়ে নাইম বলেন, ‘আমেরিকা-ইউরোপে আমাদের তৈরি করা কিছু পোশাকের প্রতিটি বিক্রি হয় ১০০ ডলারে। অথচ আমরা মাসেও ১০০ ডলারের বেশি বেতন পাই না।’

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীতে সাকল্যে ৪৮ বর্গফুটের এক বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন নাইম। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। ভাতের প্রায় খালি পাতিল দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই পাতিলে রান্না হওয়া ভাতই ছিল শেষ। এগুলো শেষ হলে খাওয়ার আর কিছু থাকবে না। খাবার জোগাতে হলে হয় আমাকে ধার করতে হবে, নয়তো ভিক্ষা করতে হবে।’

প্রায় ১৯ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার (২০৮ ডলার) টাকা করার দাবিতে গত মাসে দেশে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ হয়; হাজারো শ্রমিক মাঠে নেমে আসেন। বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানি হয়। নাইম প্রামাণিকও এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের দারুণ অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে গার্মেন্টস শিল্প। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি দারুণ! দেশটি মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। জারা, ইউনিকলো, লিভাইজ ও এইচঅ্যান্ডএমের মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো—অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা লাখো শ্রমিকের দারিদ্র্য দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

পাঁচ বছর আগে নির্ধারিত মজুরির চেয়ে মাত্র ৮ হাজার ৩০০ টাকা বেশি দাবি করেছেন শ্রমিকরা। নাইমের মতে, ৭৫ ডলার মাসিক মজুরি জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। তখন একটি গণমাধ্যমকে দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন নাইম। সেই মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুদিন পরই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

এ বিষয়ে নাইম বলেন, ‘আমরা ন্যায্য দাবির আদায়ে রাস্তায় নেমেছিলাম এবং সে কারণেই আমার কারখানা আমাকে বরখাস্ত করেছিল।’ তবে নাইম প্রামাণিকের সাবেক কর্মস্থল ওয়্যার ম্যাগের মুখপাত্র মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘তাঁকে বরখাস্ত করার কারণ হলো—তিনি টানা কয়েক দিন কাজে যোগ দেননি।’

চাকরি ছাড়ার সময় এককালীন ৬৭ হাজার টাকা পেয়েছিলেন নাইম প্রামাণিক। কিন্তু ঋণ শোধ করতেই ব্যয় হয়ে গেছে অধিকাংশ অর্থ। যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে তিনি আগামী মাসে বাসা ভাড়া দেবেন নাকি দৈনন্দিন ব্যয় মেটাবেন তা নিয়ে সন্দিহান।

নাইম প্রামাণিকের আয়ের বড় একটি অংশই চলে যায় সিরাজগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়িতে। তিনি বলেন, বাসা ভাড়া ও ঋণ শোধের পর তাঁর হাতে আর কিছুই থাকে না। ফলে সন্তানদের প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ করতে পারেন না তিনি।

পল্লবীর যে বস্তিতে নাইম থাকেন, সেখানে আরও আটটি পরিবারের সঙ্গে মিলে রান্নাঘর ও টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। পোশাকশ্রমিকের জীবনযাত্রার মান কত নিম্ন হতে পারে তা বুঝাতে এএফপির প্রতিবেদকের উদ্দেশে নাইম বলেন, ‘স্রেফ আমার ঘরের দিকেই তাকান, এখানে কিছুই নেই। আমরা ঘুমাইও একটি ভাঙা বিছানায়।’
 
সরকারের নিয়োগ করা মজুরি বোর্ড গত মাসে ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু এই টাকায় বাসা ভাড়া, চিকিৎসা, খাদ্য ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে।

আন্তর্জাতিক গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্লিন ক্লদস ক্যাম্পেইন এই ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গে বলেছে, এই পরিমাণ অর্থও (২৩ হাজার) আসলে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়, তবে এই পরিমাণ অর্থ শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের সর্বনিম্ন পরিমাণ।

পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের পর শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো আন্দোলন বন্ধ রেখেছে। তবে আগামী জানুয়ারির মধ্যে দাবি মেনে নেওয়া না হলে তাঁরা আবারও মাঠে নামবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।

আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ধনিকশ্রেণিদের মধ্যে অন্যতম হলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা এবং তাঁদের কয়েকজন আবার আইনপ্রণেতাও।

তবে নাইম প্রামাণিকই একমাত্র শ্রমিক নন, যাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, আন্দোলন-বিক্ষোভে যোগ দেওয়া শত শত শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতা প্রদীপ রায় (৩৮) বলেন, আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা এখন ‘সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। আন্দোলনে যোগ দিয়ে চাকরি হারানো একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী, যার এক সন্তানও আছে।

নিরাপত্তা হুমকির ভয়ে তিনি পরিচয় প্রকাশ করেননি। তখন তাঁর কাছে মাত্র ৪ ডলার বা ৫০০ টাকার মতো ছিল। এই নারী বলেন, ‘আমি জানি না, এই মাসটা আমি কীভাবে কাটাব। আমি জানি না, আমি কীভাবে আমার ছেলের যত্ন নেব…এদিকে বাসা ভাড়া দেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here