যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়ার পর এবার ঢাকা থেকে বিমানের সরাসরি কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল জার্মানি। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। তবে অন্য দেশের মাধ্যমে রি-স্কেনিং করে জার্মানিতে কার্গো রফতানি অব্যাহত থাকবে। এর আগে গত মার্চে যুক্তরাজ্য ও ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়াও একই কায়দায় ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো একই সুরে জার্মানিও অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও জনবলের অভাবকে দায়ী করেছে। একই সঙ্গে তারা বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য হচ্ছে জার্মানি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখন সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করায় বিমানকে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসবে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বেশ কিছু পণ্য।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের (৮৮ হাজার কোটি টাকা) পণ্য রফতানি হচ্ছে। যার বড় অংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর দ্বিতীয় স্থানে আছে জার্মানি। পাশাপাশি এ সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষ কর্তাদেও কোনো মাথাব্যথা নেই।
সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করা প্রসঙ্গে জার্মান সিভিল এভিয়েশন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এখনও কোনো চিঠি দেয়নি। তবে বন্ধের বিষয়টি তারা অন্যভাবে শুনেছেন।
এদিকে রোববার রাতে হঠাৎ ঢাকা থেকে জার্মানিতে বিমানে সরাসরি কার্গো রফতানি বন্ধ হয়ে পড়ায় জার্মানির রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স লুফথান্সার একটি ফ্লাইট সোমবার সকালে কার্গো পণ্য ছাড়াই ফেরত গেছে। লুফথান্সা কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্লাইটে মালামাল লোড করেও পরে নামিয়ে ফেলে। তবে রোববার রাত থেকে তারা দিল্লি ও শারজাহ সিভিল এভিয়েশনের কাছে তাদের কার্গো পণ্যগুলো রি-স্ক্যানিং করে দেয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। জার্মান সিভিল এভিয়েশন বিমানকে যে চিঠি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কোনো কার্গো পণ্য তারা জার্মানিতে প্রবেশ করতে দেবে না। এক্ষেত্রে সব পণ্য জার্মান সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত দ্বিতীয় কোনো দেশ থেকে রি-স্ক্যানিং করে নিতে হবে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহে ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে সরাসরি কার্গো পণ্য যাচ্ছে জার্মানিতে। ওই ফ্লাইটে গড়ে ৭০ থেকে ১০০ টন কার্গো পণ্য যায়। জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ার লুফথান্সার একটি কার্গো ফ্লাইট এ পণ্য বহন করছে। তবে লুফথান্সা ছাড়াও অন্য দেশে রি-স্ক্যানিং করে জার্মানিতে মালামাল পরিবহন করছে বড় বড় এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে এমিরেটস, কাতার, কুয়েত, ইতিহাদ, মালয়েশিয়া, সাউদিয়া, এয়ার এরাবিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, চায়না ও ওমান এয়ারলাইন্স অন্যতম। লুফথান্সার মাধ্যমে যে পরিমাণ কার্গো সরাসরি বহন করা হতো- তা থেকে মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করত বিমান।
এখন এ আয় থেকে বঞ্চিত হবে বিমান। বিজিএমইএ বলছে, তৈরি পোশাক খাতের একটা বড় অংশ জার্মানিতে রফতানি করা হয় জিরো ট্যারিফে। এর সবটাই যায় আকাশপথে। বর্তমানে জরুরিভিত্তিতে গার্মেন্ট পণ্যের নমুনাও সরাসরি আকাশপথে জার্মানিতে পাঠানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল।
জানা গেছে, অপ্রতুল নিরাপত্তা ও বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশের অজুহাতে বিমানে কার্গো নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানি। তারা জানিয়েছে, বিমানের কার্গো রফতানি টার্মিনালটি বহিরাগত জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এসব জনবল নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) নামে একটি সংগঠনের দখলে রয়েছে পুরো কার্গো রফতানি টার্মিনাল। তারা প্রায় এক হাজার জনবল দিয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিবেশে রফতানিকৃত কার্গো পণ্য লোড-আনলোড করছে। বিমান ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তাদের ড্রেস ও সিকিউরিটি পাস দিয়ে অবাধে কার্গো টার্মিনালে প্রবেশের সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। বাপার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষ কর্তাদের সুসম্পর্ক থাকায় ৬ মাস ধরে বাপা কর্মীরা অবাধে কার্গো টার্মিনালে যাতায়াত করছে।
অভিযোগ আছে, বিমান বোর্ড সম্প্রতি এক সভায় বাপার এসব কর্মীকে বিমানের কার্গো শাখায় নিয়োগ দেয়ার জন্যও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে নিয়োগকৃত যুক্তরাজ্যের সিকিউরিটি কোম্পানি রেডলাইনের সঙ্গেও এ বাপার শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে রেডলাইন কর্তৃপক্ষ গোপনে বাপার ২শ’ কর্মীকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও রেডলাইনকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। অথচ তারা কাজ করছে বেসরকারি সংগঠন বাপার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া নিয়ে। এ অবস্থায় ৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাজ্যের রেডলাইন কোম্পানির নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাপা কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশ চোরাচালানসহ একাধিক মামলার আসামি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। নামমাত্র স্ক্যানের পর এরা টার্মিনালে প্রবেশ করছে। একইভাবে স্ক্যান ছাড়াই অবাধে পণ্যসামগ্রীও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে উঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় কার্গো পণ্যের সঙ্গে বিস্ফোরক বা অন্য কোনো এক্সপ্লোসিভ বিমানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার মতো আশংকার কথাও বলা হয়েছে জার্মানির রিপোর্টে। এছাড়া নিরাপত্তা শিথিলতায় কার্গো ফ্রেইটগুলো যেসব দেশের বিমানবন্দরে যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের নাশকতার আশংকাও করা হচ্ছে। এসব কারণে তারা বিমানে সরাসরি কার্গো নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
কার্গো শাখা সূত্রে জানা গেছে, তারা ইউরোপে সরাসরি কার্গো রফতানি করতে প্রয়োজনীয় সনদ ‘রেগুলেশন এজেন্ট-৩ (আরএ)’ সনদ পেয়েছে। শিগগির তারা ‘এয়ার কার্গো সিকিউরিটি-৩ (এসিসি)’ সনদও পাবে। বিজিএমইএ সভাপতি ও বিমানের বোর্ড মেম্বার ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়ার পর জার্মানি বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে সরাসরি কার্গো নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিপাকে পড়বে তৈরি পোশাক খাত। আকাশ পথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ও নমুনা পাঠানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বিকল্প পথে অন্য দেশের আশ্রয় নিতে হবে।
তবে তিনি বলেন, জার্মানি তৃতীয় দেশে রি-স্ক্যানিং করে পণ্য নেয়ার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আজ-কালের মধ্যে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জার্মান সিভিল এভিয়েশন থেকে বিশেষজ্ঞ টিম আসছে। তারা সিভিল এভিয়েশন ও বিমানের সঙ্গে কথা বলবে। এরপরই জানা যাবে জার্মানির সঙ্গে কার্গো পণ্য পরিবহনের সর্বশেষ অবস্থা। তিনি আশা করছেন, এর মধ্যেই এটা মীমাংসা হয়ে যাবে।