পোশাক খাতের সংস্কারবিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশের (অ্যাকর্ড) কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে অ্যাকর্ড। এ বিষয়ে সরকারকে রাজি করাতে উন্নয়ন সহযোগী এবং কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন জোটের নেতারা। অ্যাকর্ডের মেয়াদ আর না বাড়াতে আদালতের প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞার পর এ বিষয়ে প্রভাব খাটাতে সরকারকেও সরাসরি অনুরোধ করা হয়েছে। তবে সব অনুরোধ আমলে নেয়নি সরকার। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হচ্ছে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডপর্ব। বাংলাদেশে অধিককাল কাজ করার ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হতে পারে ২০০ ব্র্যান্ডের এ জোটকে।
বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই দ্বিতীয় মেয়াদে ‘সেকেন্ড অ্যাকর্ড’ নামে আগের মতোই স্বাধীনভাবে সংস্কার কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যাকর্ড। গত বছরের ২৭ অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অ্যাকর্ডের অংশীদারদের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। তবে জোটের অনেক অংশীদার এখনও এতে সই করেনি। ২০০ ব্র্যান্ডের মধ্যে ১৪০টি ব্র্যান্ড মেয়াদ বাড়াতে সম্মত বলে সমকালের কাছে দাবি করেছেন অ্যাকর্ডের প্রধান নির্বাহী রব ওয়েজ। জোটের দাবি, এতেই ১২০০ কারখানায় বর্ধিত মেয়াদে কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ চালিয়ে নিতে সরকারের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি হয়নি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর একই বছরের ১৫ মে ইউরোপের ২০টি দেশসহ উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ২০০ ব্র্যান্ড এবং খুচরা ক্রেতা ও কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ে অ্যাকর্ড গঠিত হয়। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ৫ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়েছে গত মে মাসে। তবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে অতিরিক্ত ৬ মাস সময় এ দেশে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে অ্যাকর্ড এবং অপর ক্রেতাজোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্সকে। বর্ধিত সেই মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী নভেম্বরে। এর মধ্যেই গত ৯ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে অ্যাকর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ সময় পর্যন্ত সরকার গঠিত ট্রানজিশন মনিটরিং কমিটির (টিএমও) তত্ত্বাবধানে কাজ করতে বলা হয়েছে তাদের।
অ্যাকর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া আগামী ৩ বছরের বর্ধিত মেয়াদের বিষয়ে সরকারের অনুমোদন থাকার তথ্যও আমলে নিয়েছেন আদালত। এতে বলা হয়, আদালত খবর নিয়ে জেনেছেন এ-সংক্রান্ত কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। অ্যাকর্ডের পক্ষে আইনজীবী কে এস সালাউদ্দিন আহমেদ আদালতে এ বিষয়ে কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি। গত ২৬ অক্টোবর অ্যাকর্ড তাদের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৯ অক্টোবর সরকার অ্যাকর্ডের ৩ বছরের বর্ধিত মেয়াদ অনুমোদন করেছে।
এসব বিষয়ে অ্যাকর্ডের বক্তব্য জানতে সমকালের পক্ষ থেকে ই-মেইল বার্তায় যোগাযোগ করা হলে জোটের প্রধান নির্বাহী রব ওয়েজ ফিরতি ই-মেইল বার্তায় জানান, বিষয়টি যেহেতু আদালত এবং আইনি প্রক্রিয়ার অংশ সে কারণে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না তারা। তবে ১৪০টি ব্র্যান্ড এবং খুচরা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ট্রানজিশনাল অ্যাকর্ড বা বর্ধিত মেয়াদের অ্যাকর্ডের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে যাতে যে সব কারখানা থেকে তারা পোশাক নেয় সেগুলো পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকে। লিখিত বার্তায় তিনি সরকারের সঙ্গে তাদের বৈঠকের প্রসঙ্গ এনে বলেন, অক্টোবরে ওই বৈঠকে সরকার এবং বিজিএমইএ অন্তর্বর্তীকালীন অ্যাকর্ড হিসেবে এ দেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অবশ্য কত দিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অ্যাকর্ডের কার্যক্রম চলবে তা উল্লেখ করেননি তিনি।
এদিকে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম নিয়ে অস্বস্তিতে আছে বিজিএমইএ। সরকারের কাছে তাদের কার্যক্রম নিয়ে কয়েক দফা অভিযোগও করেছেন সংগঠনের নেতারা। অ্যাকর্ডের অতিরিক্ত সময় কিছুতেই চান না তারা। বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সমকালকে বলেন, মেয়াদ বাড়ানোর প্রশ্নই আসে না। বরং সরকার গঠিত রিমিডিয়েশন কোঅর্ডিনেশন সেলে (আরসিসি) তারা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। অ্যাকর্ডের প্রয়োজনীয়তা থাকলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করা যেত। কিন্তু তাদের তো আর প্রয়োজন নেই। কারণ, অ্যাকর্ডভুক্ত কারখানার সংস্কার প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তাছাড়া নেদারল্যান্ডসের আইনে একটা স্বাধীন দেশে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
অ্যাকর্ডভুক্ত ক্রেতারা যে সব কারখানা থেকে পোশাক নেয় এরকম দুই হাজার ৯৬টি কারখানাকে প্রাথমিক পরিদর্শনের জন্য বাছাই করা হয়। এরমধ্যে এক হাজার ৬৩১টি কারখানার প্রাথমিক পরিদর্শন শেষ হয়েছে। নতুন করে পরিদর্শনের কথা রয়েছে ৭৪টির। ৪৯টিকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ৮৮টি। সংস্কার অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থতার অভিযোগে ৯৬টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে। স্থানান্তর আবশ্যক হওয়া বাকি ৫৮টি কারখানা এখন আর অ্যাকর্ডের আওতায় নেই। তবে অ্যাকর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক পরিদর্শনে চিহ্নিত ভবনের কাঠামো, অগ্নি নিরাপত্তা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ত্রুটির ৮৪ ভাগ ইতিমধ্যে সংশোধন হয়েছে।