Home Blog Page 425

‘গামেন্টস শ্রমিকরা করোনাভাইরাসে নয়, অনাহারে মারা যাবে‌’

“আমাদের শ্রমিকরা যদি করোনাভাইরাসে না মরে, তারা মরবে অনাহারে, না খেতে পেয়ে।” একটি পোশাক কারখানার মালিক ভিজয় মাহতানি এরকমটাই আশঙ্কা করছেন। ‘অ্যামবাটুর ফ্যাশন ইন্ডিয়া‌’র চেয়ারম্যান তিনি। করোনাভাইরাসের বিশ্ব মহামারি পোশাক শিল্প খাতে কী প্রভাব ফেলছে সেটা বলছিলেন তিনি। স্বাভাবিক সময়ে ভিজয় মাহতানি এবং তার ব্যবসায়িক অংশীদার অমিত মাহতানি এবং শাওন ইসলাম তিনটি দেশে যে ব্যবসা চালান, সেখানে কাজ করেন প্রায় ১৮ হাজার কর্মী। বাংলাদেশ, ভারত এবং জর্ডানে তাদের কারখানা। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর তারা তাদের ব্যবসার একটা বিরাট অংশ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। কেবল ঢাকার কারখানাটি অংশিক চালু আছে। শ্রমিকদের তারা যে মজুরি দিতে পারছেন না সেটা কেবল করোনাভাইরাস লকডাউনের কারণে নয়। তাদের মূল সমস্যা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের বড় বড় ক্রেতাদের অন্যায্য দাবি। “অনেক ব্রান্ড সত্যিকারের অংশীদার হিসেবে পাশে দাঁড়াচ্ছে, নীতি-নৈতিকতা মেনে চলছে। তারা চেষ্টা করছে নগদ অর্থের সরবরাহ যেন অব্যাহত থাকে, যাতে শ্রমিকদের বেতন দেয়া যায়,” বলছেন অমিত মাহতানি। জর্ডানের টাস্কার অ্যাপারেলের প্রধান নির্বাহী তিনি। “কিন্তু আমাদের এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে যেখানে তৈরি হচ্ছে বা হয়ে গেছে এমন জিনিসের অর্ডার বাতিলের জন্য তারা চাপ দিয়েছে। ট্রানজিটে আছে এমন পণ্য বা বকেয়া পাওনার ওপর ডিসকাউন্ট দাবি করেছে। অনেকে বকেয়া পরিশোধের সময় আরো ৩০ বাআ ১২০ দিন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে।” বিবিসির হাতে এমন একটি ইমেইল আছে, যাতে একটি মার্কিন কোম্পানি সব ধরণের অর্ডারে তিরিশ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চেয়েছে। এর মধ্যে আছে ইতোমধ্যে ডেলিভারি দিয়ে দেয়া পণ্যও। তারা কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এখন যেতে হচ্ছে, তার কথা। “শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা যায় সেটাই কেবল তাদের চিন্তা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা তারা বিবেচনাতেই রাখছে না। দায়িত্বশীলভাবে পণ্য সংগ্রহের যে কথা তারা বলে, তার তোয়াক্কা না করে তারা এখন ভন্ডামির আশ্রয় নিচ্ছে”, বলছেন বিজয় মাহতানি। “ব্রান্ডগুলোর মনোযোগ থাকে শেয়ারের দামের দিকে। তাদের হাতে এই দুর্যোগের সময় যথেষ্ট অর্থ নেই। পুরো সাপ্লাই চেইনে তারাই এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে। তারা এখন আমাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছে সাহায্যের জন্য। যখন তাদের কীনা দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচতে মার্কিন সরকারের আর্থিক প্রণোদনা পেতে আবেদন করা উচিত।” এসব ঘটছে এমন এক সময় যখন করোনাভাইরাস লকডাউনের কারণে পোশাক প্রস্তুতকারকরা দুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ। প্রথম সমস্যা দেখা দিয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে, যখন চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চীন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাপড় রফতানিকারক। বছরে ১১৮ বিলিয়ন ডলারের কাপড় রফতানি করে তারা। এরপর সম্প্রতি যখন চীনের টেক্সটাইল কারখানাগুলো খুলতে শুরু করে, গার্মেন্টস কারখানা মালিকরা আশা করছিলেন এবার তারা উৎপাদন আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তারপর এলো দ্বিতীয় ধাক্কা- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে গেল দোকান-পাট। চাহিদা পড়ে গেল রাতারাতি।

গুরুত্বপূর্ণ শিল্প

চীনকে বলা হয় সারা বিশ্বের কারখানা। কিন্তু তৈরি পোশাকের বেলায় বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমার পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। “গত দশ বছর ধরে তৈরি পোশাক শিল্প চীন থেকে অন্যান্য দেশে সরে যাচ্ছে। কারণ চীনে এখন খরচ পড়ছে বেশি”, বলছেন পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘লিভার স্টাইলে‌’র স্ট্যানলি সেটো। নামকরা সব ব্রান্ডের পোশাক সরবরাহ করে তার কোম্পানি। এর মানে হচ্ছে এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য পোশাক শিল্প এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানিকারক চারটি দেশের দুটি হচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম । বিশ্ব বাজারে মোট রফতানির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ যায় বাংলাদেশ থেকে, আর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ভিয়েতনাম থেকে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ। গত বছর বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ এসেছে এই খাত থেকে। ক্যাম্বোডিয়া এবং শ্রীলঙ্কাও এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাদের রফতানির ৬০ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে যত মানুষ কাজ করে, তার প্রায় অর্ধেক এই শিল্পে নিয়োজিত। অন্যদিকে ক্যাম্বোডিয়ায় আরো বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ। ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়্যারের ফ্যাশন এন্ড অ্যাপারেল স্টাডিজের শেং লু বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া এবং ভারতের গার্মেন্টস শিল্পে ৪ হতে ৯ শতাংশ পর্যন্ত মানুষ কাজ হারাতে পারে। এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক শিল্পকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের স্প্যারো অ্যাপারেলসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাওন ইসলাম বলেন, “সরকার খুবই উদার এক আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে যাতে শ্রমিকদের বেতনে ভর্তুকি দেয়া যায়, ব্যাংক ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া যায় এবং সুদের হার যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে রাখা যায়। যে ঝড় আসছে তার মোকাবেলায় এটা হয়তো যথেষ্ট নয়, তারপরও এটি আমাদের সাহায্য করবে।” ক্যাম্বোডিয়ার সরকারও পোশাক খাতের জন্য নানা রকম সহায়তা ঘোষণা করেছে। শ্রমিকদের মজুরি দেয়ার জন্য ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রফেসর লু বলেন, এসব দেশকে এরকম পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে কারণ মহামারির কারণে শ্রমিক সংকট থেকে শুরু করে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া- এরকম নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে কোন কোন ব্রান্ড সমালোচনার মুখে এখন অঙ্গীকার করছে যে তারা তাদের বতর্মান সব অর্ডারের পুরু দাম শোধ করবে। যেমন এইচ-এন্ড-এম এবং ইনডিটেক্স এমন ঘোষণা দিয়েছে। ‘লেবার বিহাইন্ড লেবেল’ নামে এ কটি শ্রমিক অধিকার সংস্থার ডোমিনিক মুলার বলেন, “ব্রান্ডগুলো বহু বছর ধরে কম মজুরির দেশগুলোতে পোশাক বানিয়ে মুনাফা করেছে। এসব দেশে কোন ধরণের সোশ্যাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা নেই। এই বিজনেস মডেলে কোন কোন ব্রান্ডের তো বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শ্রমিকদের যেভাবে শোষণ করা হয়েছে এখন সেই দেনা পরিশোধের পালা।” কারখানা মালিক অমিত মাহতানি একথার সঙ্গে একমত। “বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই শিল্পকে রক্ষায় ধনী দেশগুলোকে বেইলআউটের ব্যবস্থা করতে হবে।” এটি ছাড়া, তার মতে, এই শিল্প একেবারেই ধসে পড়বে।

ক্রেতাদের শুদ্ধাচার নিশ্চিতের আহ্বান এশিয়ার গার্মেন্ট মালিকদের

বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে তৈরি পোশাক পণ্য সরবরাহ ক্রয় পর্যায়ে শুদ্ধাচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে এশিয়া অঞ্চলের নয়টি কারখানা মালিক সংগঠন

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপণন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাসংগঠনগুলো ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল করার প্রেক্ষাপটে বুধবার এ বিবৃতি দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, কভিড-১৯ এর এই প্রদুর্ভাব সময়ে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ও ক্ষতি পরিপূরণের লক্ষ্যে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দায়িত্বশীল ব্যবসা-বাণিজ্য বেশি প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল খাতের শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা ঠিক রাখতে ক্রেতা, ব্র্যান্ড ও ট্রেডার্স ও খুচরা বিক্রেতাদের দায়িত্বশীল ক্রয়াদেশের চর্চা করতে হবে।

সাসটেইনেবল টেক্সটাইল অব এশিয়ান রিজিয়ন বা স্টার নামের আমব্রেলা সংগঠনের ব্যানারে বিবৃতিদাতাদের মধ্যে বাংলাদেশের বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ছাড়াও চায়না ন্যাশনাল অ্যাপারেলস অ্যান্ড টেক্সটাইল কাউন্সিল (সিএনটিএসি), গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ইন কম্বোডিয়া (জিএমএসি), মিয়ানমার গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (এমজিএমএ), পাকিস্তান হোসিয়ারি ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিএইচএমএ), পাকিস্তান টেক্সটাইল টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশন (পিটিইএ), টাওয়েল ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্থান (টিএমএ) ও  ভিয়েতনাম টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ভিআইটিএএস) রয়েছে।

ক্রেতাদের প্রতি পোশাকমালিকদের দাবি :

* যে কোনো ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের ওপর এর প্রভাব বিবেচনা করবেন।

* ক্রয়চুক্তির শর্তগুলোর প্রতি অবশ্যই সম্মান দেখাবেন, আদেশ দেওয়ার পর নতুন করে মূল্য নির্ধারণের আলোচনায় আসবেন না।

* যেসব পণ্য তৈরি হয়ে গেছে অথবা তৈরি হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে তা অবশ্যই গ্রহণ করবেন এবং চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করবেন।

* কোনো ক্রয়াদেশ স্থগিত করতে হলে সরবরাহকারীদের জাহাজিকরণের (এফওবি) সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করুন; অথবা সংশ্লিষ্ট সাপ্লায়ারের শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দিন।

* দেরিতে পণ্য সরবরাহের জন্য সরবরাহকারীদের ওপর কোনো ক্ষতিপূরণ আরোপ করবেন না; তাদের ওপর বাড়তি খরচের  দায়ভার চাপাবেন না।

* বেচাকেনার মধ্যে ভালো বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের নিয়ে আলোচনার চর্চা করুন।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারাদেশের অচলাবস্থার মধ্যেও ‘জরুরি প্রয়োজনে’ মোট ৪১টি কারখানা চালু রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।

বুধবার বিজিএমইএর পক্ষ থেকে  সাংবাদিকদের জানান হয়, সাভারের আশুলিয়া এলাকায় ছয়টি, চট্টগ্রামে ১০টি, গাজীপুরে ২১টি, ঢাকা মেট্টপলিটন এলাকায় চারটি গার্মেন্টস খোলা রয়েছে। নারায়নগঞ্জ এলাকায় কোন পোশাক কারখানা খোলা নেই।

এদিন পর্যন্ত কতটি পোশাক কারখানা মার্চ মাসের বেতনভাতা দিয়েছে তা জানতে চাইলেও বিজিএমইএর গণমাধ্যম শাখা তা জানাতে পারেনি।

৩১১ কোটি ডলারের রফতানি ক্রয়াদেশ স্থগিত-বাতিল

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একের পর এক ক্রয়াদেশ হারাচ্ছে তৈরি পোশাক খাত।  শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য বলছে, আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ১ হাজার ১২৩ কারখানায় ৩১১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে।

সংগঠনটির দেয়া তথ্যমতে, বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ১২৩ কারখানার ৩১১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত হয়েছে। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৭ কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার পিস পোশাক। ১ হাজার ১২৩ কারখানার আওতায় আছে ২২ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক।

সূত্রমতে, ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও আছে।  আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করেছে ইউরোপের ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাও। আবার এইচএন্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতা ক্রয়াদেশ বহাল রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ফলে ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো একের পর এক লকডাউন ঘোষণা করছে। বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করছে পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তা চাহিদায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বাজার চাহিদার এ পরিস্থিতিতে নতুন ক্রয়াদেশ দিচ্ছে না ক্রেতারা। শুধু তাই নয়, বাতিল ও স্থগিত করছে আগের দেয়া ক্রয়াদেশও, যার ফলে ব্যাপক মাত্রায় ক্রয়াদেশ হারাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত।

করোনার প্রভাবে প্রথমে কাঁচামাল সরবরাহ সংকটে পড়তে হয়েছিল পোশাক খাতকে। কারণ দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্য তৈরির আনুমানিক শতকরা ৬০ শতাংশ কাপড় চীন থেকে আমদানি হয়।  আর নিট পণ্য তৈরির আনুমানিক শতকরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। 

চীনে করোনাভাইরাস হানা দেয়ায় দেশটি থেকে কাঁচামাল আসতে পারছিল না। কারণ করোনার প্রভাবে দেশটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন চাহিদা সংকটে পড়েছে পোশাক খাত। এ পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকের বেতন পরিশোধে প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার।

বন্ধের মধ্যে চলছে ৬৭টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা

শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে দেরিতে হলেও পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ তাদের সদস্য কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়। তারপরও বুধবার সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়নসিংহ ও খুলনায় ৬৭টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা উৎপাদন কাজ চালিয়েছে। এসব অঞ্চলের অন্যান্য ৪৩৮টি শিল্পকারখানাও চালু ছিল। এই হিসাবে ঢাকা মহানগরের তথ্য নেই।

শিল্প পুলিশ জানায়, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও খুলনায় ৩ হাজার ৩৭১টি পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকলসহ ৭ হাজার ৬০২টি শিল্পকারখানা রয়েছে। তার মধ্যে বুধবার চালু ছিল ৫০৫টি। তবে মঙ্গলবার উৎপাদনে ছিল ৫৪৬টি শিল্পকারখানা।

বুধবার উৎপাদনে থাকা ৫০৫টি শিল্পকারখানার মধ্যে পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকলের সংখ্যা ৬৭টি। তার মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ৪৩টি ও বিকেএমইএর ৫টি রয়েছে। আর বিটিএমএর সদস্য ১৯টি বস্ত্রকল চালু রয়েছে। বেপজার অধীনে ইপিজেডগুলোতে ৩৬৪ কারখানার মধ্যে চালু ছিল মাত্র একটি। বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুরের জয়নাল নিট কম্পোজিট, ফ্যাশন স্টেপ, ট্রাউজার ল্যান্ড, তমা নিটওয়্যার, ওনাস অ্যাপারেলস, বাংজিন বাংলাদেশ, ওরিয়েন্ট এলিউর লিনগেরি, ইসলাম গ্রুপের ইসলাম নিটওয়্যার ও ইসলাম ডিজাইন, হরাইজন ফ্যাশন, কোয়াট্রো ফ্যাশন, হ্যাগ, রোমো ফ্যাশন, কোস্ট টু কোস্ট, আইরিশ ডিজাইন, দ্যাটস ইট ফ্যাশন, গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন, অকোটেক্স, আশুলিয়ায় কিউট ড্রেস, মিলেনিয়াম, আজিজ ফ্যাশনস, ওরিয়ন ফ্যাশন ইত্যাদি পোশাক কারখানা বুধবার উৎপাদনে ছিল।

শুরুতে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও কারখানা বন্ধ রাখতে চায়নি সরকার ও পোশাকশিল্প মালিকেরা। সমন্বয়ের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দল বেঁধে পোশাকশ্রমিকদের এক দফা যাওয়া-আসার পালা শেষ হয়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর গত সোমবার করোনার এই মহামারির সময়ে প্রথমবারের মতো পোশাক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। অবশ্য তার আগে সরকারের ওপর মহল থেকে কারখানা বন্ধ করতে সংগঠন দুটিকে বলা হয়।

সোমবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যৌথ বিবৃতিতে বলে, ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধ থাকবে। তবে যেসব কারখানা সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই বানাচ্ছে এবং যাদের জরুরি রপ্তানি ক্রয়াদেশ আছে, কেবল তারাই কারখানা চালাতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সংগঠন, শিল্প পুলিশ এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। সেদিন রাতেই বিটিএমএ একইভাবে বস্ত্রকল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক জানান, উৎপাদনে থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ৪টি পিপিই বানাচ্ছে।

বিকেএমইএর সদস্য ৫টি কারখানা চালুর বিষয়ে সংগঠনটির সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘প্রতিটি কারখানা করোনা প্রতিরোধে জরুরি সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই বানাচ্ছে। আমরা সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি।’

অন্যদিকে বিটিএমএর সচিব মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার চারটি বস্ত্রকল চালু থাকার তথ্য পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বুধবার আমাদের জানামতে কোনো বস্ত্রকল চালু ছিল না। শিল্প পুলিশ আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

মজুরি দেয়নি অধিকাংশ কারখানা
অধিকাংশ পোশাক কারখানা এখনো মজুরি পরিশোধ করেনি। যদিও কারখানা বন্ধ থাকার কারণে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে মজুরি পরিশোধের অনুরোধ করেছে। কিছু কারখানা বন্ধের মধ্যেও মজুরি পরিশোধ করেছে।

শিল্প পুলিশের তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়নসিংহ ও খুলনার ১ হাজার ৮৮২ কারখানার মধ্যে ১৮৬টি বেতন-ভাতা দিয়েছে। আর বিকেএমইএর ১ হাজার ১০১টি কারখানার মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে ৫৭টি।

উৎপাদন বন্ধ থাকলেও মঙ্গলবার সারা দিন কয়েক ধাপে ২ হাজার শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করেছে নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনস নামের নিট পোশাক কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো বেশ কিছু ছবিতে দেখা যায়, করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ৩ থেকে ৪ ফুট দূরত্বে নারী শ্রমিকেরা দাঁড়িয়ে আছেন। সুশৃঙ্খলভাবে তারা কাউন্টার থেকে বুঝে নিচ্ছেন মার্চ মাসের মজুরি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২৬ মার্চ থেকে আমাদের কারখানা বন্ধ। করোনার এই বিশেষ পরিস্থিতিতে মজুরি দেওয়ার জন্য কয়েক ধাপে শ্রমিকদের আসতে বলা হয়। বসানো হয়েছিল ১০টি বুথ। আমরা সারা দিন ধরে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করেছি। কারখানায় অনেক খোলা জায়গা থাকায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজটি করা সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই উদ্যোক্তা।

একইভাবে গাজীপুরের শ্রীপুরে ডিজাইনটেক্স লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানা মঙ্গলবার সামাজিক দূরত্ব মেনে শ্রমিকদের মজুরি দিয়েছে। কারখানাটিতে কাজ করেন ২ হাজার ৪০০ শ্রমিক। কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব শ্রমিকই মঙ্গলবার মজুরি নিয়েছেন।’

পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল করলে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান

করোনার এই সময়ে উৎপাদিত বা সরবরাহ করা পোশাকের কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করলে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ক্রয়াদেশের এফওবি (ফ্রেইড অন বোর্ড) মূল্যের শতভাগ পরিশোধ করতে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে স্টার নেটওয়ার্ক। স্টার নেটওয়ার্ক বুধবার এক বিবৃতিতে করোনা সংকট মোকাবিলায় এই আহ্বান জানিয়েছে। এশিয়ার ছয় দেশের পোশাক, বস্ত্র, হোসিয়ারি ও টাওয়েল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নয়টি ব্যবসায়িক সংগঠনের জোট এই স্টার নেটওয়ার্ক বা সাসটেইনেবল টেক্সটাইল অব দ্য এশিয়ান রিজিওন। এতে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। বিবৃতিতে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্টার নেটওয়ার্ক পণ্যে কোনো ক্রয়াদেশ জাহাজীকরণ হয়ে গেলে তার মূল্য পরিশোধ করার পাশাপাশি কারখানায় কোনো ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদন হয়ে গেলে কিংবা উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল প্রস্তুত হলে সেই ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত না করার আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে উৎপাদিত বা জাহাজীকরণ সম্পন্ন কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করলে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানিয়েছে স্টার নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহে বিলম্ব হলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি না করা, ক্রয়াদেশের শর্তাবলি সঠিকভাবে মেনে চলা, কোনো ধরনের সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বিষয়ে জোর দিয়েছে স্টার নেটওয়ার্ক। স্টার নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। এ ছাড়া চীনের ন্যাশনাল টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল কাউন্সিল (সিএনটিএসি), গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ইন কম্বোডিয়া (জিএমএসি), মিয়ানমার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (এমজিএমএ), পাকিস্তান হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিএইচএমএ), পাকিস্তান টেক্সটাইল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিটিইএ), টাওয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান (টিএমএ) এবং ভিয়েতনাম টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ভিআইটিএএস) স্টার নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। করোনার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ১১৯ কারখানার ৯৬ কোটি পিস পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। তাতে ৩০৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনটাই জানিয়েছে বিজিএমইএ। অবশ্য সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম তাদের মনোনীত কারখানায় ইতিমধ্যে যেসব পোশাক তৈরি হয়েছে, সেসব নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকটা সেই পথেই হাঁটবে বলে পোশাক রপ্তানিকারকদের ইতিমধ্যে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পিভিএইচ, স্পেনের ইন্ডিটেক্স, যুক্তরাজ্যের মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস), ফ্রান্সের কিয়াবি, যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটসহ কয়েকটি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া প্রাইমার্ক পোশাকশ্রমিকদের জন্য একটি তহবিল গঠন করেছে। তহবিলের অর্থ পাবেন বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের শ্রমিকেরা।

দুর্গতিতে পোশাকশ্রমিকেরা: বর্তমান নিরুপায়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

করোনার কালেও পেটে ভাত দিতে হয়। পেট অনেকগুলো। ‘দেশে’ দুটি ছোট মেয়ে, বুড়ো মা আর শ্বশুর। ঢাকায় নিজে আর স্বামী। ‘কামাইকাজের লোক’ শুধু স্বামী-স্ত্রী দুজন।  দুজন গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে একই কারখানায় কাজ করেন। ৩১ মার্চ কাজের শেষে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে কারখানাটি বন্ধ হয়। তাঁরা সেদিনই দেশে চলে যান। ৫ এপ্রিল কারখানা খোলার কথা ছিল। মোসাম্মাত রাবেয়া বেগম সেদিন সকালে স্বামীর সঙ্গে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নবীনর গ্রাম থেকে টঙ্গী ফিরে আসেন। এসে কারখানা বন্ধ পান।  সেদিনই দুপুর ১২টার দিকে পাগাড় সোসাইটির মাঠ এলাকায় তাঁদের ভাড়া বাসায় আমার সঙ্গে রাবেয়ার দেখা। বললেন, ওভারটাইমসহ দুজনে মিলে মাসে কমবেশি ২০ হাজার টাকা আয় করেন। তাই দিয়ে গ্রামের আর এখানকার দুই সংসার চলে।  রাবেয়া বলেন, আগের রাতে ট্রাকে করে, পায়ে হেঁটে, বহু কষ্টে ফিরেছেন—‘একদিন অ্যাবসেন্ট করলে যদি আমাদের বাইর কইরা দেয়, তয় তো করার কিছু নাই।’ ছুটি আরও বাড়বে জানলে এখন তাঁরা ফিরতেন না। পথে পথে পুলিশ গাড়ি থামিয়েছে। ড্রাইভার বাড়তি টাকা নিয়েছেন। টাকা লেগেছে ২ হাজারের মতো। মার্চের বেতন থেকে বাড়িতে টাকা দিয়েছেন। গাড়িভাড়া দিয়ে হাতে এখন টাকা নেই। রাবেয়া বলেন, ‘আর তো খাওয়ার মতো তৌফিক নাই ঘরে।’ টঙ্গীরই পূর্ব গোপালপুর এলাকায় স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন মোসাম্মাত নাজমা আক্তার। তিনি আর তাঁর স্বামী দুজনই পোশাকশ্রমিক।  নাজমা বলেন, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে জেনে ২৫ মার্চ তাঁরা বগুড়ার শেরপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এপ্রিলের গোড়ায় সরকার সাধারণ ছুটি বাড়াল। নাজমা ভেবেছিলেন, তাঁদের ছুটিও বাড়বে। নাজমার কথায়, ‘একটা মসজিদে যদি ১০০ জন লোক একসাথে যাইতে সরকার থেইকা নিষেধ করা হয়, তাইলে একটা গার্মেন্টসে দুই-তিন হাজার লোক কেমন করে কাজ করবে?’ নাজমা জানতেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা খোলা রাখা যাবে। তবু তিনি ৩ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, সরকার অথবা কারখানার মালিকের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করেন।  এদিকে অফিসে ব্যবস্থাপকদের ফোন করলে তাঁরা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেন। ‘মালিক যদি খোলা রাখে, আর এই সময় যদি চাকরি চলে যায়, এই ভয়ে আমার বাধ্য হয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়াই আসছি’—বলেন নাজমা। ৪ এপ্রিল রাতে টঙ্গী ফিরে নাজমা শোনেন, বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ রাখতে অনুরোধ করছে। তাঁর প্রশ্ন, ‘এই যে আমাদের একটা ভোগান্তি, গ্রামে যারা ছিল, তারা বাড়িতেই ছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ যে আবার ঢাকা শহরে আইল, এটা কি বিজিএমইএ কিংবা সরকারের একটা জ্ঞানহীনতার পরিচয় না?’ কিন্তু প্রশ্নটা কি নিছক জ্ঞানহীনতার? প্রভাবশালী কারও হেলাফেলা আর স্বার্থচিন্তার চূড়ান্ত প্রকাশও কি এটা নয়?  বাণিজ্যমন্ত্রী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। গত প্রায় ২০ দিনে বিজিএমইএ ও নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ একাধিকবার কারখানা খোলা রাখার পক্ষে সায় দিয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকেও একাধিকবার এই বার্তা গেছে যে সুরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করাসহ জরুরি প্রয়োজনে কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখা যাবে।  অবশেষে মালিকদের সংগঠন দুটিও ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার সুস্পষ্ট যৌথ ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে, সংগঠনকে জানিয়ে কেবল পিপিই বানানো আর জরুরি রপ্তানি ক্রয়াদেশের কাজ চলতে পারবে।  যাক। আমরা ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বাসী। আজ মনে হলো এতটুকু করি, কাল মনে হলো কড়াকড়ি আরেকটু বাড়াই। ছুটি বাড়াই দুদিন করে করে। করোনাভাইরাসকে ধাপে ধাপে বরণ করি অথবা অল্পে অল্পে কুলার বাতাস দিয়ে তাড়াতে চাই।  এদিকে করোনা-বন্ধ বা লকডাউন না চললেও রাবেয়া এখন দেশে ফিরতে পারতেন না। তাঁর মার্চের বেতন শেষ, দোকানে বাকি পাওয়া অনিশ্চিত। তিনি বলেন, ‘এই যে বন্ধের পর বন্ধ দিতাছে, সামনের স্যালারি পাব কি না, হের তো কোনো নিশ্চয়তা নাই।’ এসে থেকে শুনছেন, কারখানার কাজের আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারখানা চলবে কি না, সেটা জানা তাঁর বড় দরকার। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস ছাড়া তো আমাদের কিছু নাই। বাড়ি যায়া করব কী?’ মালিকেরা কী করেন, সেই আশাতেই থাকতে হবে।  নাজমাও অপেক্ষা করছেন। প্রথমত, মার্চের বেতনের জন্য। দ্বিতীয়ত, তিনি শুনেছেন, সরকার তিন মাসের বেতন-ভাতার জন্য সাহায্য দেবে। কীভাবে কখন তা পাবেন, সেটা জানতে চান।  বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে মার্চের বেতন দিয়ে দিতে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করেছে। টঙ্গী থেকে ফিরে রাতে ফোন করি বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামালকে। তিনি বললেন, বেশির ভাগ কারখানা শ্রম আইনের ১৬-এর ২ ধারায় কাজ বন্ধ করেছে।  এতে করে শ্রমিকেরা লে-অফের নিয়মে বন্ধের পর ৪৫ দিন পর্যন্ত বেতন-ভাতা পাবেন। বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও খাদ্যভাতা পুরোপুরি, আর মূল বেতনের অর্ধেক। কারখানা যদি আরও অন্তত ১৫ দিন বন্ধ থাকে, তবে শ্রমিকেরা মূল বেতনের এক-চতুর্থাংশ এবং ভাতাগুলো পাবেন। তবে আইন বলছে, সে ক্ষেত্রে মালিক আইনের ২০ ধারায় প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে ছাঁটাইও করতে পারবেন।  আরশাদ জামাল বলছেন, কারখানা কাজ হারিয়ে পথে বসতে নিলে তেমন ছাঁটাই হতে পারে। বন্ধ অত দিন গড়ালে কারখানাগুলোর কাজে অন্য রকম জট লেগে যাবে।  মালিকেরা কিন্তু আরও আগে থেকেই এসব সমস্যার কথা বলে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা চেয়ে আসছেন। সরকার একাধিক আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণাও করেছে। এগুলোর একটি হচ্ছে রাবেয়া নাজমাদের মতো শ্রমিকদের জুন পর্যন্ত তিন মাস বেতন দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ঋণসুবিধা।  এই ঋণ পেতে হলে প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত বেতন দেওয়ার এবং রপ্তানি চলমান থাকার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। ঋণদাতা ব্যাংক সরাসরি বেতনের টাকাটা শ্রমিকের ব্যাংক অথবা মোবাইলের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে। বেতন ধরা হবে আগের তিন মাসের গড় বেতনের নিরিখে।  কথাবার্তা বলে যা বুঝলাম, শিল্পমালিকেরা এই ঋণ ও বেতন দেওয়ার পথটি খুব সহজ বলে ভাবছেন না। পরিশোধ করতে হবে, সেটা একটা জটিলতা। লে-অফের নিয়মে আধা বেতন না কি তিন মাসের গড় বেতনের সমপরিমাণ, সে নিয়েও একটা বাহাস লেগে যেতে পারে।  তা ছাড়া বদলি বা সাময়িক শ্রমিকেরা কিন্তু এসব কোনো সুযোগের দাবিদার হবেন না। শুনলাম, তেমন শ্রমিকেরা এখনই ছাঁটাই হচ্ছেন। বড় কারখানার পাশাপাশি ঠিকা ছোট কারখানাতেও অনেক শ্রমিক কাজ করেন। এগুলো বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকবে। এটা ঠিক যে করোনার আসর মালিকদের রেয়াত দেবে না। তবে সরকারের কাছে দেনদরবার করার পথ তাঁদের সর্বদা খোলা থাকে। রাবেয়া বা নাজমার গলা কার কানেই-বা পৌঁছাবে?

Roadblock in going for full digital salary payment overnight

Only 9 per cent garment factories pay wages to workers through mobile financial services (MFS) and 4 per cent through banks, according to a new study, whose findings may make it difficult for the country to digitally pay 4.1 million apparel workers overnight.  As many as 76 per cent garment factories pay wages to workers through cash, while 11 per cent disburse salaries through multiple models, the survey of the Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association (BGMEA) showed. The BGMEA conducted the survey to know the payment modes used by factory owners as the factory management has been preparing MFS accounts for workers to submit to banks. The finance ministry and the Bangladesh Bank have made it mandatory for the factory owners to present the list of workers and their MFS and bank account numbers to banks if they want to use the government’s Tk 5,000 crore stimulus package to pay workers. The banks have been asked to directly pay to the workers’ accounts. The BGMEA survey was conducted among 160 factories, which employ 225,710 workers. Of the workers, 101,379, or 45 per cent of the workers surveyed, have MFS accounts. They use bKash, Rocket and similar kinds of MFS accounts. “Using MFS, 1 per cent of the surveyed factories pay salaries to employees and 9 percent factories pay wages to workers. This is insignificant,” the study said. In Bangladesh, garment workers are grouped in seven grades. Wages are given to the graded workers and the salary to the non-graded employees, such as freshers and trainees. Some 147,111 workers, or 65 per cent of the total, have national identification (NID) cards. Some factories have reported that the workers who were not able to provide NID had submitted birth certificates. This is a clear indication that NID information must be obtained for all workers of a factory to ensure proper background verification, said the study. Since not all workers and employees possess a smartphone, it might get in the way of going for 100 per cent MFS coverage outright. The limitation of the study is it asked about the smartphone, but a good number of workers may have feature phones that may be used to operate MFS accounts. The study recommended immediate action to enforce the opening of the MFS account of workers for wage payment. There are a good number of workers who are not registered with the workers’ database of the BGMEA. It called for making workers’ database registration mandatory and uploading the data within the next 30 days, or by May 10. The BGMEA’s e-wallet should be rolled out immediately. The survey asked the BGMEA to ask its members to collect the NID of workers and verify them well. The wages and salary payment should be well-preserved and it will be a part of critical resources for the industry, the study said. Providing support to enhance the availability of smartphones or any kind of mobile devices for the workers can be ensured with the support of development partners. This step can trigger the use of MFS accounts by workers, who now shy away from it for lack of mobile devices. “MFS is not a choice for us any longer,” said Rubana Huq, president of the BGMEA. Rather it is mandatory to ensure transparency of the sector. “Moreover, through a bank account or MFS, we could also save the hassle of workers coming to factories for salary. The sector does not have anything to hide or shy away from,” Huq told The Daily Star in a WhatsApp message. It’s possible to open MFS accounts by this month, she said, adding that salaries for April need to be paid by the first week of next month. “So, if we have the accounts by the first working days of May, it’s all good.” All will be paid the salary for March. There’s no reason to be worried about it, she said. BGMEA members pay wages worth Tk 4,000 crore a month.

Apparel manufacturers of 6 countries ask buyers to honour contracts

Nine textile and garment business associations in six countries including Bangladesh on Wednesday asked the global brands and buyers to honour the terms of readymade garment purchasing contracts and not re-negotiate price or payment terms during this unprecedented global pandemic of COVID-19.  In a joint statement, the platforms requested brands, retailers and global buyers to consider potential impacts on workers and small businesses in the supply chain when taking significant purchasing decisions. Sustainable Textile of Asian Region, a platform of six countries, called on their buyers to take delivery or shipment, and proceed with payment as agreed upon for goods already produced and currently in production with materials ready, and not cancel orders which are already in production. The platform of manufacturing countries, known as STAR Network, called on buyers for offering fair compensation to suppliers if production or delivery has to be suspended or stopped. The manufacturers associations also asked global buyers for putting no responsibility on suppliers for delay of delivery or shipment and claim no compensation for such delays and no further improper pressure on suppliers by additional costs, rush orders or unnecessary visits and audits. The nine associations in six countries are Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association, Bangladesh Knitwear Manufacturers and Exporters Association, China National Textile and Apparel Council, Garment Manufacturers Association in Cambodia, Myanmar Garment Manufacturers Association, Pakistan Hosiery Manufacturers and Exporters Association, Pakistan Textile Exporters Association, Towel Manufacturers Association of Pakistan, and Vietnam Textile and Garment Association. The statement said that responsible business had become more important than ever for the whole world to survive and recover from the coronavirus crisis. ‘Especially, responsible purchasing practices of brand companies, retailers and traders of the global textile and apparel supply chains, will bring enormous impacts on the fundamental rights of millions of workers and the livelihood of their families in the supplier end,’ the statement said. STAR Network said that it was time for global businesses to uphold and honour their commitment to labour rights, social responsibility and sustainable supply chains. It also called on the brands and buyers to make all efforts and engage with local stakeholders for a better understanding of the local situation and contexts and support business partners on supply chain as much as possible. It also called for aiming at a long-term strategy of business continuity, supply chain unity and social sustainability. ‘We appreciate the understanding, collaboration and support of our business partners and other stakeholders, and we are ready to work and walk with all responsible buyers globally to get through this crisis, towards a shared bright future,’ the statement said.

ছাঁটাই শুরু পোশাক কারখানায়

১০ এপ্রিল, শুক্রবার। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ওই একদিনেই কাজ হারিয়েছেন ৪০৬ জন শ্রমিক। পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ সদস্য কারখানাটি জার্সিসহ নানা ধরনের স্পোর্টসওয়্যার তৈরি ও রফতানি করে। এর আগে ৭ এপ্রিল গাজীপুরেরই আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ হারিয়েছেন ১৭০ জন শ্রমিক। শ্রম ও শিল্পসংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, একই এলাকায় দুটি কারখানায় ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটলেও শুধু গাজীপুরেই নয়, দেশের সব পোশাক কারখানায়ই কম-বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছে।

কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশ থেকে পোশাকের আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ। স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হওয়ায় সেসব দেশে পোশাকপণ্যের চাহিদা কমে গেছে ব্যাপক হারে। আবার এদিকে বাংলাদেশেও ক্রমেই বাড়ছে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও চলছে অঘোষিত লকডাউন। জরুরি ছাড়া শিল্প-কারখানার উৎপাদনও তাই কার্যত বন্ধ।

সূত্র বলছে, এ প্রেক্ষাপটে আসন্ন মন্দা মোকাবেলায় পোশাক শিল্প মালিকরা ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে শুরু করে দিয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটলেও এর ব্যাপকতা বাড়বে মূলত সংকট কাটতে শুরু করলে। এছাড়া নভেল করোনাভাইরাসজনিত সংকটে শ্রমিক ছাঁটাই না করার বিষয়ে সরকারের দিকনির্দেশনাও রয়েছে। তাই ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই এখনো শুরু হয়নি। তবে আইন অনুসরণ করে ‘রিট্রেঞ্চমেন্ট’ বা ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি অস্বীকার করেননি সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, কাজের বয়স এক বছরের নিচে এমন শ্রমিকদের আইনসম্মত ‘রিট্রেঞ্চমেন্ট’ হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রতিটি সদস্যকে এমনটা না করতে অনুরোধ করেছি। গত রোববারও আমরা এ বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি।

শ্রম ও শিল্পসংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রায় সব পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। আর এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাছাই করা হচ্ছে এক বছরের কম সময় ধরে কাজ করছেন এমন শ্রমিকদের। কিছু কারখানায় ভবিষ্যতে ছাঁটাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেতন পরিশোধ করে শ্রমিকদের পরিচয়পত্র রেখে দেয়া হলেও শ্রম ও শিল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরিচয়পত্র আবার ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার সাধারণ ছুটি চলাকালীন শ্রমিক ছাঁটাই আইনসম্মত নয় বলেও মালিকরা গণহারে শ্রমিক ছাঁটাই থেকে বিরত আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের এক পরিদর্শক বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার নেতিবাচক প্রভাব এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। মন্দাও আসন্ন। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন কোনো কাজ আসছে না। এ অবস্থায় মানবিক বিবেচনায় শ্রমিক দীর্ঘদিন বসিয়ে রেখে বেতন দেয়া কোনো মালিকের পক্ষেই সম্ভব না। যাদের আর্থিক সক্ষমতা নাজুক তারা এখনই শ্রমিক ছাঁটাই করতে চাইছেন। সরকারি সহায়তা কাজে লাগিয়েও তিন মাস শ্রমিক বসিয়ে রাখা মালিকদের পক্ষে কঠিন বলে জানিয়েছেন তারা। বর্তমানে মার্চের বেতন পরিশোধ চলছে, সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলেও কিছু কারখানা জরুরি কাজে সচল আছে।

দেশের শিল্প অধ্যুষিত আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, ময়মনসিংহ—এই ছয় এলাকায় বিজিএমইএ সদস্য পোশাক কারখানা আছে ১ হাজার ৮৮২টি। এর মধ্যে মার্চের বেতন পরিশোধ করা কারখানার সংখ্যা গতকাল ছিল ২৪৭। বিকেএমইএ সদস্য পোশাক কারখানা ১ হাজার ১০১টি। এর মধ্যে মার্চের বেতন পরিশোধ করেছে এমন কারখানার সংখ্যা গতকাল ছিল ১২৩।

এদিকে সরকারের সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় রেখে দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও গতকাল খোলা ছিল বেশকিছু কারখানা। শিল্প অধ্যুষিত ছয় এলাকায় বিজিএমইএ সদস্য ১ হাজার ৮৮২ কারখানার মধ্যে গতকাল বন্ধ ছিল ১ হাজার ৮৫৬টি। আর বিকেএমইএ সদস্য ১ হাজার ১০১ কারখানার মধ্যে বন্ধ ছিল ১ হাজার ১০০টি। এ হিসাবে দুই সংগঠন মিলিয়ে খোলা ছিল ২৭টি কারখানা।

ক্রয়াদেশ স্থগিত না করতে এশিয়ার নয় সংগঠনের আহ্বান

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের সময়ে একের পর এক তৈরি পোশাকের রফতানি বা ক্রয় আদেশ বাতিল করেছে বিভিন্ন ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। এতে বড় সঙ্কটের মুখে পোশাক খাত। কর্ম হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। এমন অবস্থায় শ্রমঘন শিল্প খাতটি টিকিয়ে রাখা জরুরি। তাই কঠিন এ সঙ্কটময় মুহূর্তে ক্রয় আদেশ স্থগিত না করে চুক্তির শর্ত যথাযথ পরিপালনের জন্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও পোশাক ব্যবসায়ী ক্রেতাদের কাছে দাবি জানিয়েছে এশিয়া অঞ্চলের ছয়টি দেশের ৯টি পোশাক উৎপাদনকারী এবং রফতানিকারক সংগঠন।

এক যৌথ বিবৃতিতে সঙ্কটময় সময়ে তৈরি পোশাক খাত বাঁচাতে ও পুনরুদ্ধার করতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের কাছে ৯ দফা দাবি তুলে ধরেছে সংগঠনগুলো।

গত ৪ এপ্রিল সংগঠনগুলোর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময়ে বিশ্বের গার্মেন্ট খাতকে সঙ্কট থেকে বাঁচাতে ও পুনরুদ্ধার করতে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় এসেছে। বিশেষত বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল এবং পোশাক সরবরাহকারী চেইনের ব্র্যান্ড সংস্থাগুলো ও খুচরা বিক্রেতাদের। তা না হলে লাখ লাখ শ্রমিকের মৌলিক অধিকার এবং তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহের ওপর এর ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব পড়বে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, শ্রম অধিকার, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং টেকসই সরবরাহ চেইনের প্রতি বৈশ্বিক ব্যবসার প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং সম্মান দেখানোর এখনই সময়। বিষয়টি মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি টেকসই টেক্সটাইল অব এশিয়ান রিজিয়ন (স্টার নেটওয়ার্ক) সদস্যদের ছয়টি উৎপাদনকারী এবং রফতানিকারক দেশ থেকে ৯টি শীর্ষ টেক্সটাইল এবং গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সংগঠন এ আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া রয়েছে।

পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারকদের দাবিগুলো হলো :

১. উল্লেখযোগ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সাপ্লাই চেইনে শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ের ওপর সব সম্ভাব্য প্রভাব সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করুন; ২. ক্রয় চুক্তির শর্তগুলোকে সম্মান ও দায়বদ্ধতাগুলো পালন করুন এবং মূল্য বা অর্থ প্রদানের শর্তগুলো পুনরায় আলোচনা করুন; ৩. শিপমেন্ট নিন এবং ইতোমধ্যে উৎপাদিত এবং বর্তমানে প্রস্তুতকৃত সামগ্রী বাতিল না করে অর্থ প্রদানের সঙ্গে এগিয়ে যান; ৪. উৎপাদন বা বিতরণ স্থগিত বা বাতিল হয়ে থাকলে শ্রমিকদের বেতন ও পণ্য সরবরাহকারীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিন; ৫. এ মূহূর্তে পণ্য সরবরাহে বিলম্বের জন্য সরবরাহকারীদের ওপর কোনো দায় চাপাবেন না এবং এ জাতীয় বিলম্বের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন না; ৬. অহেতুক আদেশ ও অপ্রয়োজনীয় পরিদর্শন এবং নিরীক্ষণ দ্বারা অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি করে পণ্য সরবরাহকারীদের ওপর অনুচিত চাপ দেবেন না; ৭. স্থানীয় পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপট ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন; ৮. সমস্যার পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানগুলো নিশ্চিত করতে সর্বদা সংলাপ এবং সহযোগী মনোভাব অবলম্বন করুন; ৯. ব্যবসায়ী অংশীদারদের যথাসম্ভব সমর্থন করুন। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা রক্ষায় এক হোন।

স্টার নেটওয়ার্কের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে দেশের শীর্ষ তৈরি পোশাকের সংগঠন ‘বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)’, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), চীনের চায়না ন্যাশনাল টেক্সটাইল এবং অ্যাপারিল কাউন্সিল (সিএনটিএসি), কম্বোডিয়ার গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (জিএমএসি), মিয়ানমার গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন (এমজিএমএ), পাকিস্তান হোসিয়ারি গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন (পিএইচএমএ), পাকিস্তান টেক্সটাইল এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (পিটিইএ), তোয়ালে ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান (টিএমএ) এবং ভিয়েতনাম টেক্সটাইল এ্যান্ড গার্মেন্টস এ্যাসোসিয়েশন (ভিটাস)।

এদিকে দেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমেরিকা, ইউরোপ ও কানাডা লকডাউন হয়ে আছে। ফলে প্রত্যেক দেশের ক্রয় আদেশ স্থগিত করে বার্তা পাঠাচ্ছে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এতে বড় সঙ্কটের মুখে পোশাক খাত। ঝুঁকিতে পড়বে পুরো রফতানি বাণিজ্য।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত গভীর সঙ্কটের মধ্যে দিন পার করছে। একের পর এক পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে এ খাত ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। তাই কঠিন এ সঙ্কটময় মুহূর্তে বায়ারদের ক্রয় আদেশ স্থগিত না করার আহ্বান জানিয়েছেন পোশাক মালিকরা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পরে ক্রেতারা এখন পর্যন্ত ২৯১ কোটি মার্কিন ডলার তৈরি পোশাকের রফতানি বা ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন।

বিজিএমইএর সব শেষ তথ্য অনুযায়ী, ৮ এপ্রিল সকাল ১০টা পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক খাতের এক হাজার ১১৯টি কারখানায় ৯৬ কোটি ৪০ লাখ পোশাক পণ্যের রফতানি আদেশ বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ৩ দশমিক ০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় দাঁড়ায় ২৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, বিনিময় হার ৮৫ টাকা ধরে)।

বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে, রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া এসব কারখানায় ২২ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। দেশে বর্তমানে পোশাক কারখানা রয়েছে চার হাজার ৫৬০টি। যেখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। দেশের অর্থনীতিতে রফতানি পোশাকের মোট অবদান ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্যান্য রফতানির উপখাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

এক দশক ধরে দেশের জিডিপি ৬ শতাংশের উপরে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে এ পোশাক খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।

RMG BANGLADESH NEWS