ডাঃ তিতাস মাহমুদ
(যুক্তরাস্ট্রে কর্মরত চিকিৎসক)
‘করোনা’ এই
নামটি আসলে একটি পরিবারের নাম। মানুষের ভেতরে যেমন চৌধুরী, চক্রবর্তী, স্মিথ, জোনস্
এমন সব পরিবার থাকে, ‘করোনা’ তেমনি একটা ভাইরাস পরিবারের নাম। আমাদের যেমন বড় দাদা,
চাচা, বাবা, বড়ভাই, ছোটভাই থাকে, ‘করোনা’ পরিবাবেরও অনেক সদস্য থাকে। এদের ছোট মামা
হয়তো খুব ভালো কিন্তু সেঝ ফুপা দেখা গেলো ডাকাতি করেন। এই পরিবারের সবাই মোটামুটি খুব ক্ষুদ্র আকৃতির
এবং দূর্বল প্রকৃতির হয়। এই ভাইরাসগুলো একা বাঁচতে পারেনা; এদেরকে ভর করতে হয় মানুষের অথবা অন্য কোনো প্রাণীর
দেহের উপর। এরা এতো ছোট যে এদের খালি চোখে দেখা যায় না। মানুষের এবং প্রাণীর শরীরে
ঢুকে এরা বড়জোর ৭/১০ দিন বেঁচে থাকে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি, নানারকম সৈন্য
সামন্ত পাঠিয়ে শুধু করোনা নয়, এধরণের সব পরজীবী জীবাণুকে ধরে বেধে এনে মেরে ফেলে।
এই ধরপাকড়ের
সময় কোন কোন ভাইরাস প্রানপনে আত্মরক্ষার পথ খুঁজতে থাকে। ব্যাপার খানা এমন যে, ‘আমরা
ভাইরাস হয়েছি বলে কী আমাদের বাঁচার অধিকার থাকতে নেই।’ প্রাণীর শরীরের ভেতরে ভাইরাসগুলোকে
বাঁচতে হলে তার একটাই উপায় আছে। আর সেটা হলো নিজেদের শারিরীক গঠন, আকৃতি, প্রকৃতি পরিবর্তন
করে মানুষের দেহকোষের সাথে অনেকটা ক্যামোফ্লেজের মতো মিশে যাওয়া। এ কাজটা এতো সহজ নয়। এমন একটা রূপ নিতে ভাইরাসের
বছরের পর বছর সময় লেগে যেতে পারে। যেটাকে প্রাণী দেহের সেনা সামন্তরা শত্রু বলে ঠাওর
করতে পারবে না। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দিলে দেখা যায়, ‘করোনা’ পরিবারের সবারই পুরো
শরীর জুড়ে রাজা বাদশাহর মুকুটের মতো চোখা চোখা অনেক গুলো ‘স্পাইক’ আছে। আদতে এই মুকুট
বা ‘ক্রাউন’ শব্দটি থেকেই মানুষ এই ভাইরাস পরিবারের নাম দিয়েছে ‘করোনা।’
বর্তমান যে
করোনা ভাইরাসটি পৃথিবীতে মহামারী আকারে ছড়িয়েছে, ওর আসল নামটা অনেক লম্বা। সবাই ওকে
ছোট নামে ‘কোভিড ১৯’ বলে ডাকে। মনে করা হচ্ছে, এই ভাইরাসটির জন্ম চায়নার হুবেই প্রদেশের
উহান শহরে সামুদ্রিক মাছের শরীরের ভিতরে। সাধারণ একটি করোনা ভাইরাস যখন মরা বাঁচার
যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তখন আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে এদের কয়েকজন তাদের মুকুটের একটি স্পাইক
সুচতুরভাবে পাল্টিয়ে ফেলে। নতুন স্পাইকটি অনেকটা নিখুঁত চাবির মতো, যা প্রাণীর একটি
দেহকোষের দরোজার তালা খুলে ফেলতে পারে । তারপর সে দিব্যি সেই কোষের ভেতরে ঢুকে নিশ্চিন্তে
গা ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। এবং শুধু তাই নয়, ভাইরাসটি
তার নিজের RNA আমাদের দেহকোষের ভেতরের DNA এর সাথে জুড়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ নতুন
প্রজন্ম তৈরী করে। গেল বছরের শেষদিকে উহান শহরে হঠাৎ হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে হাজির
হলেন অন্য একরকম নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। ওদের প্রত্যেকের প্রবল টানা সাতদিনের জ্বর
সাথে শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, এরা সবাই কোন না কোন
ভাবে সেই সামুদ্রিক মাছ বাজারের সাথে সংযুক্ত ছিলেন।
প্রথমে সামুদ্রিক
মাছ তারপর রোগাক্রান্ত মানুষের ভিতরে বেড়ে ওঠা পরিবর্তিত এই করোনা ভাইরাস গুলোই আজকের
কোভিড ১৯। এদের মুকুটের দুর্দান্ত চাবিটি আমাদের শ্বাসতন্ত্রের ACE 2 দরজার তালার সাথে হবুহু মিলে যায়। কোভিড ১৯
আমাদের কোষে ( নিউমোসাইট ২) ভিতর ঢুকে নিজেদের লক্ষ লক্ষ কপি তৈরী করতে থাকে। এতে নিউমোসাইটগুলো
ফুলে ফেঁপে উঠে একসময় ফেটে যায়। আমাদের ফুসফুসের ছোট ছোট বেলুন ( এ্যালভিউলাই) গুলো
ফুঁটো হয়ে যায়। তখন বন্যার মতো নদীর পানি হু হু করে ঢুকতে থাকে ফুসফুসের প্রতিটা কোষে
। এদিকে ভাইরাসগুলো রক্তের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে; ফুসফুস ছাড়াও শরীরের আরো যে জরুরি অঙ্গ
প্রতঙ্গ আছে, যেমন বৃক্ক, যকৃৎ, মস্তিষ্ক, কিডনি এগুলোকে আক্রমণ করে। শুরু হয় ‘মাল্টি
অর্গান ফেইলুর’ এর দুষ্টচক্রটি।
কথা ছিল সুস্থ
দেহে ফুসফুসের বেলুনগুলো সর্বদা শুষ্ক থাকবে। মানুষ সুন্দর এই পৃথিবীতে লম্বা লম্বা
শ্বাস নেবে। বাতাসের মাঝে যে ২১% অক্সিজেন আছে, তা দিয়ে আমাদের বুক ভরে উঠবে। কিন্তু
বাতাসের বদলে ‘কোভিড ১৯’ সেখানে সুনামি শুরু করে দেয়। হাসপাতালে আইসিইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা
মুখের ভিতর দিয়ে শ্বাসনালীতে নল ঢুকিয়ে অধিকতর চাপে বাইরে থেকে অক্সিজেন দেবার চেষ্টা
করেন। তাঁরা অপেক্ষা করেন কখন বেলুনগুলো আবার ফুলে উঠবে, ফুসফুসের পানি সরে যাবে। যমে
মানুষের এই টানাটানিতে অসহনীয় দুঃখ আর কষ্টের
দিন শেষে, বিধাতা কারো কারো আকাশে ফের রংধনু পাঠান। আবার কাউকে কাউকে আকাশের ওপারে
তাঁর কাছে তুলে নিয়ে যান।
‘কোভিড ১৯’
এই বদ ভাইরাসটি যেন আমাদের ফুসফুসে না ঢুকতে পারে তার জন্যে তো গোটা পৃথিবী জুড়ে আমাদের
এতো আয়োজন! আমরা সবাই দল বেঁধে সিদ্ধান্ত নিয়েছি একে অপরের থেকে দূরে থাকবো। ঘরের বাইরে
যাবো না। বারবার সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত দুই হাত পরিষ্কার ধুবো। এর পাশাপাশি
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা নিয়েও কাজ করা খুবই জরুরী। ফুসফুসের বিশেষ এই রোগ (ARDS ) থেকে বাঁচার জন্যে
অবশ্যই ধূমপান পরিত্যাগ করতে হবে। মুক্ত বাতাসে প্রচুর ব্যায়াম করতে হবে। নিয়ম করে
প্রতিদিন পর্যাপ্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার, সাথে ভিটামিন সি যুক্ত ফলফলাদি খেতে হবে। এসবের
পরেও যা খুব বেশি প্রয়োজন, তা হলো, রোগ প্রতিরোধের জন্যে অবশ্যই দৈনিক গড়ে ৭ থেকে
৮ ঘন্টা পুর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।