Home Bangla Recent পোশাক শিল্পে কর্মী সংকোচনের শঙ্কা

পোশাক শিল্পে কর্মী সংকোচনের শঙ্কা

safety-compliance-in-rmg-industry-beyond-2018

রিকশাচালক মোহাম্মদ আবদুল হালিম (৪১) একসময় ছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক। কারখানা থেকে গত বছরই চাকরি হারিয়েছেন তিনি। স্বয়ংক্রিয় বুনন যন্ত্র ‘জ্যাকার্ড মেশিন’ এসে দখল করেছে তিনিসহ আরো কয়েকজনের জায়গা। অন্য কারখানায় চাকরি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রিকশাচালকের পেশা বেছে নিয়েছেন তিনি। আবদুল হালিমের ভাষ্য, তার চাকরি যাওয়ার জন্য জ্যাকার্ড মেশিনই দায়ী।

রাজধানীর একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী ফ্যাশন সোয়েটার্স লিমিটেডের ফ্যাক্টরির ভেতরের দৃশ্য। রফতানির জন্য সোয়েটার সেলাই হচ্ছে এখানে। দৃশ্যটির বিশেষত্ব হলো এ বুনন কার্যক্রম চলছে সম্পূর্ণই স্বয়ংক্রিয়ভাবে। জার্মানিতে তৈরি ১৭৩টি যন্ত্র বিরামহীনভাবে সেলাই করে চলেছে মানুষের সহায়তা ছাড়াই। শুধু যন্ত্রগুলো দেখভালের জন্য অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন অল্প কয়েক ডজন শ্রমিক।

কয়েক বছর আগেও ফ্যাক্টরিটির ভেতরের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় ফ্যাক্টরির নিটিং শাখায় কর্মরত ছিলেন কয়েকশ শ্রমিক। এসব শ্রমিক দিনে ১০ ঘণ্টা পর্যন্তও কাজ করেছেন। মোহাম্মদী ফ্যাশনের মালিকরা গার্মেন্টের নিটিং শাখার অটোমেশন শুরু করেন ২০১২ সালের দিকে। ২০১৭ সালের মধ্যে গোটা বিভাগই হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়।

মোহাম্মদী গ্রুপের ফ্যাক্টরিগুলো বর্তমানে এইচঅ্যান্ডএম, জারা ও অন্যান্য পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য সোয়েটার উৎপাদন করছে। স্বয়ংক্রিয়করণের ফলে কাজ হারিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন ফ্যাক্টরিগুলোর ৫০০ শ্রমিক। সামনের দিনগুলোয় এ ধরনের আরো যন্ত্র নিয়ে আসতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের এখন পিছিয়ে পড়াটা অর্থহীন।’

পোশাক শিল্প এখন দ্রুত এগোচ্ছে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে। কারখানায় শ্রমিকের জায়গা করে নিচ্ছে নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি। এখনো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনেক সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। এত সস্তায় শ্রম বিক্রির পরও দ্রুত স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে কর্ম হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন এসব শ্রমিক। কারণ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও রোবট এখন তাদের কর্মস্থল দখলে নিতে শুরু করে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলো এর প্রধান সুবিধাভোগী হলেও উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর শ্রম খাতে নতুন করে শঙ্কা তৈরি করছে দ্রুত স্বয়ংক্রিয়করণ।

অথচ গার্মেন্ট শিল্পকে গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস শিল্পের মতো স্বয়ংক্রিয়করণের অতটা উপযোগী বলে মনে হয়নি কখনই। বিশেষ করে ফ্যাব্রিকের ক্ষেত্রে যন্ত্রের চেয়ে মানুষের চটপটে হাতই এক্ষেত্রে অনেক বেশি ভালো করে এসেছে সবসময়ই। এছাড়া বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও চীনে কাজ করিয়ে নেয়ার মতো শ্রমিক রয়েছে অসংখ্য। ফলে স্বয়ংক্রিয়করণের খুব একটা তাগিদ ছিল না উদ্যোক্তাদের।

কিন্তু সমস্যা হলো শ্রমব্যয় বাড়ছে। এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও। এবং প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত হয়ে পড়েছে যে, যন্ত্র এখন ফ্যাব্রিক, পকেট সেলাই ও প্যান্টে বেল্ট লুপ বসানোর মতো সংবেদনশীল ও জটিল কাজও সামলাতে সক্ষম।

এর সবই এখন পোশাক শিল্পের অর্থনীতিকে আরো উন্নত করে তুলছে। দীর্ঘদিন ধরেই দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক সিঁড়ির প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে এসেছে পোশাক শিল্প। বিশেষ করে এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলো। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, স্বয়ংক্রিয়করণের কারণে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের গার্মেন্ট, টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারাবেন।

এ বিষয়ে এমআইটি ইনিশিয়েটিভ অন ডিজিটাল ইকোনমির পরিচালক এরিক ব্রিনজোল্ফসন বলেন, ‘আমার চিন্তা হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে। অটোমেশন বিপ্লবের প্রধান শিকার হওয়ার মতো অবস্থানে এখন তারাই।’

সমস্যাটির একেবারে বাস্তব প্রতিচ্ছবি তৈরি হবে বাংলাদেশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুতবর্ধনশীল শ্রমশক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এখানে প্রতি বছর নতুন চাকরি প্রয়োজন প্রায় ২০ লাখ করে। এ চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্প অনেক বড় একটি ভূমিকা রাখতে পারত।

তবে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কমে আসছিল কয়েক বছর ধরেই। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের দিকে খাতটির বার্ষিক কর্মসংস্থান তৈরির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ। ২০১০ সালের মধ্যেই তা নেমে আসে ৬০ হাজারে। সরকারি পরিসংখ্যানেও সাপ্লাই চেইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক উঠে আসছে। আর তা হলো বেসিক টেক্সটাইলের ক্ষেত্রেও কর্মসংস্থান কমছে।

 

কর্মসংস্থান কমলেও উৎপাদন কিন্তু বাড়ছে। অটোমেশন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানোর ফলেই তা সম্ভব হয়েছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন। তথ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বিপরীতে গার্মেন্ট খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, ‘তরুণ সমাজকে যদি উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে কাজে লাগানো না যায়, তারা কিছু একটা করে বসবে এবং তারা এমন কিছু করে বসবে, যা সামাজিকভাবে খুব একটা সুখকর কিছু নয়।’

পোশাক খাতে অটোমেশনের সুবিধা পাবে উন্নত দেশগুলো। বিশেষ করে ধনী দেশগুলো। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একদিক থেকে যেমন বাড়বে তাদের বিনিয়োগ কার্যকারিতা, তেমনি জিন্সসহ ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ হিসেবে পরিচিত অন্যান্য পোশাক পণ্যের দামও কমিয়ে রাখতে সক্ষম হবে তারা। এছাড়া অটোমেশনের সুবিধা নিয়ে আগে বাড়তি শ্রম ব্যয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো যেসব দেশ থেকে পোশাক শিল্প বিদায় নিয়েছিল, তারা তা ফিরিয়ে আনতে পারে সহজেই।

উন্নত দেশগুলোর পোশাক শিল্পে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে দ্রুতগতিতে। পোশাক শিল্পের জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি উৎপাদন করছে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার অটোমেশন। যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসে পরিচালিত চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তিনইউয়ান গার্মেন্টস কোম্পানির জন্য ‘সিউবট’ (সেলাইকারী রোবট) উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী বছরই এসব সিউবট পোশাক উৎপাদনে নামবে বলে জানিয়েছে সফটওয়্যার অটোমেশন।

জার্মানি ও আটলান্টার জুতা উৎপাদন কারখানায় সুলভ শ্রমের বদলে কম্পিউটারভিত্তিক ও স্বয়ংক্রিয় বুনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে ‘স্পিডফ্যাক্টরি’ চালু করেছে এডিডাস এজি।

পোশাক শিল্পে স্বয়ংক্রিয়করণের প্রভাব প্রসঙ্গে সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পক্ষ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিক সংগঠন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তারের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, অটোমেশনের কারণে শ্রমিকদের দাবি না মানার মতো জোর পাচ্ছেন মালিকরা। এ রকম সাম্প্রতিক ঘটনায় কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন, শ্রমিকরা যদি তাদের পরিকল্পনা না মানেন; ফ্যাক্টরির কার্যক্রম পরিচালনায় স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে চলে যাবেন তারা।

নাজমা আক্তার বলেন, ‘আগে যেসব কারখানায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করত, এখন দেখা যাচ্ছে, সেখানে মাত্র ১০০ শ্রমিক কাজ করছে।’

অন্যদিকে দেশের বড় বড় কারখানা মালিকরা বলছেন, ব্যয়ের চাপ বাড়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে বড় এক পরিবর্তনের ধাক্কা লাগে। কারখানার পরিবেশ-পরিস্থিতি উন্নয়নের দাবি উঠতে থাকে সবখানেই।

অন্যদিকে কম মূল্যে নানা ধরনের পোশাক কিনে অভ্যস্ত ক্রেতারাও বাড়তি দামে পোশাক কিনে পরতে রাজি নয়। এছাড়া পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো থেকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ায় এ চাপ আরো বেড়ে যায়।

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গার্মেন্ট শিল্প এশিয়ায় স্থানান্তর হওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রথমে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর লোকের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি মিলেছে। পরবর্তীতে এ চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে থাইল্যান্ড ও চীনে। এ দেশগুলোয়ও যখন উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেল, পণ্য উৎপাদনের জন্য নতুন স্থান খুঁজতে লাগল পোশাক শিল্পের বড় ব্র্যান্ডগুলো, যার সুযোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের রফতানি বেড়ে দাঁড়ায় তিন গুণে। ফলে সে সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত লোকের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে আসে। খাতটিতে কর্মরতদের অনেকেই গ্রামের দরিদ্র এলাকা থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে স্থানান্তর হওয়া নারী। গার্মেন্টে কাজ করে পাওয়া মজুরির টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে এরা যেমন নিজ পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি বাংলাদেশের রফতানি খাতের ৮১ শতাংশ অবদানও এরাই রেখেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here