Home বাংলা নিউজ রপ্তানি ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা: গুলশান হামলা

রপ্তানি ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা: গুলশান হামলা

আশুলিয়ার রক নিটওয়্যার দুই বছর ধরে ইতালির স্টার ইন্টারন্যাশনালের পোশাক তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ক্লাউদিয় কাপেল্লি গত বৃহস্পতিবার ওই কারখানায় সারা দিন থেকে ৫৭ হাজার ডলারের পলো-শার্ট পরিদর্শন (ইন্সপেকশন) করেন। ক্লাউদিয় সেখানে ইফতারও করেন। পরদিন (শুক্রবার) রাতে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হন তিনি।

এর আগে বুধবারও রক নিটওয়্যারের কারখানায় গিয়ে ১৭ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের বারমুডা সেট (হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি) পরিদর্শন করেন ক্লাউদিয়। সেই পণ্য উড়োজাহাজে পাঠিয়ে দেয় রক নিটওয়্যার। তবে অর্থ এখনো পাওয়া যায়নি। পরদিন বৃহস্পতিবার পলো শার্ট পরিদর্শনকালে একটি স্টিকার পরিবর্তনের পরামর্শ দেন ক্লাউদিয়। তাই এ পণ্য আর পাঠানো হয়নি। জানতে চাইলে রক নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে এলেই নিজের জন্য পোশাক তৈরি করিয়ে নিয়ে যেতেন ক্লাউদিয়। বৃহস্পতিবার নিজের জন্য একটি গেঞ্জি ও একটি প্যান্ট বানাতে দিয়েছিলেন তিনি। শনিবার সেগুলো তাঁকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই তিনি গুলশানের জঙ্গি হামলায় নিহত হলেন। শামসুল হক আরও বলেন, ‘ক্লাউদিয়র মারা যাওয়ার খবর শোনার পর থেকেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। জানি না, কপালে কী আছে।’

স্টার ইন্টারন্যাশনালের বায়িং হাউস হিসেবে কাজ করে ফেডো ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ফেডো ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্লাউদিয়া দান্তোনাও নিহত হন। একই জঙ্গি হামলায় এই দুজনসহ মোট নয়জন ইতালীয় মারা যান। রক নিটওয়্যারে কাজ করেন ৩০০ শ্রমিক। একটি ক্রয়াদেশ আটকে যাওয়ার কারণে গতকাল রোববার পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারেননি শামসুল হক। অন্যান্য বার ঈদের আগের এই সময়ে ব্যাংক জরুরিভাবে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করলেও ক্লাউদিয় নিহত হওয়ার খবর শোনার পর এবার ব্যাংক কোনো সহযোগিতা করছে না। শামসুল হক বলেন, ‘আমার কারখানাটি একেবারেই ছোট। যেভাবেই হোক কাল (আজ) তো বেতন দিতেই হবে।’

নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশনও স্টার ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ব্যবসা করে। স্টারের ক্রয়াদেশ পেয়ে ২০ হাজার মার্কিন ডলারের পোশাক তৈরি করেছে তারা। ঈদের আগেই তা রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। সেই পোশাকও পরিদর্শন করেছিলেন ক্লাউদিয় কাপেল্লি। এমবি নিট ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাউদিয়া কাপেল্লি নিহত হওয়ায় এই ২০ হাজার ডলারের পোশাকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

শুক্রবারের জঙ্গি হামলায় নিহত বিদেশিদের মধ্যে আরও রয়েছেন জাপানের ৭, ভারতের ১ এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের ১ জন। ইতালির নিহত ৯ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন পোশাক ক্রেতা। আর ৭ জাপানিই ছিলেন মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষক।

জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে জাপানের সহায়তা ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গতকাল সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল পরিদর্শনের সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে জাইকার একটি প্রতিনিধিদল গতকাল ঢাকায় এসেছে।

২০২১ সালে পোশাক খাত থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা প্রায়ই বলে থাকেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। গুলশান হামলার মতো ঘটনা চলতে থাকলে কীভাবে তা সম্ভব হবে— জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, একটা গোষ্ঠী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই এর জবাব দেবে।

ঘটনার প্রভাব জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনায় সাময়িক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশ। আর আমাদের বেশি রপ্তানি হয় ইইউতে। আবার জার্মানিসহ তিনটি দেশ ইতিমধ্যে বাংলাদেশি পণ্যের সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।’

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, শনি ও রোববার ইউরোপ-আমেরিকার সাপ্তাহিক ছুটি। সে কারণে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাননি তাঁরা। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ এখন সারা বিশ্বেরই সমস্যা। বাংলাদেশের এ ঘটনায় তাই পোশাক রপ্তানিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না।’ তিনি বলেন, তবে এ ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে সতর্ক হবেন।

তবে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, গুলশানের ঘটনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে জঙ্গি হামলা হলেও মনে রাখতে হবে যে তারা ক্রেতা দেশ। তারা সেসব দেশেই যায়, যেখানে নিরাপত্তা আছে।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, গুলশানের মতো ঘটনা চলতে থাকলে বাংলাদেশে আসতেই ইতস্তত বোধ করবেন বিদেশিরা। দেশজুড়ে যে সেবায়েতদের কোপানো হচ্ছে, সেগুলোও ঠেকাতে হবে। নইলে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে যাবে এবং বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য দেশকে বেছে নেবেন বিদেশিরা।