Home বাংলা নিউজ চামড়া শিল্পনগরীতেও পরিবেশ দূষণ: পানিতে মিশছে বিষাক্ত বর্জ্য, পরিশোধন ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ

চামড়া শিল্পনগরীতেও পরিবেশ দূষণ: পানিতে মিশছে বিষাক্ত বর্জ্য, পরিশোধন ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ

সাভার চামড়া শিল্পনগরীর বিষাক্ত বর্জ্য এভাবেই মিশছে ধলেশ্বরী নদীতে

বুড়িগঙ্গা এবং এর আশপাশে পরিবেশ দূষণের বড় কারণ হাজারীবাগের ট্যানারি। ট্যানারির দূষণ থেকে রেহাই পেতে সাভারে পরিকল্পিতভাবে একটি চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করেছে সরকার। সেখানে ট্যানারি স্থানান্তর শুরু হয়েছে। শুরুতেই সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে সাভার শিল্পনগরীর মাধ্যমেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ট্যানারির বিষাক্ত তরল বর্জ্যে এখন একাকার চামড়া শিল্প এলাকা। এ ছাড়া ট্যানারির বর্জ্য মিশছে ধলেশ্বরী নদীর পানিতে। স্থানীয়রা এর প্রতিবাদে ইতিমধ্যে মানববন্ধনও করেছেন। কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়াই ট্যানারি চালুর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদরা।

২০০৩ সালে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় সরকার। হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দেড় শতাধিক ট্যানারি সরানোর প্রক্রিয়া চলছে ১৩ বছর ধরে। ট্যানারি স্থানান্তর নিয়ে সরকারের সঙ্গে মালিকদের মতবিরোধ রয়েছে। দফায় দফায় আলোচনা করেও যখন স্থানান্তর আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছিল তখন আদালতের জরিমানা আরোপের ফলে ট্যানারি মালিকরা এখন সাভারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে ৩০টি ট্যানারি সাভারে চালু করা হয়েছে। বেশিরভাগ ট্যানারি আগামী মাসের মধ্যে স্থানান্তর হওয়ার কথা।

গত রোববার সরেজমিন দেখা যায়, সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রধান গেটে দূষণ রোধে এলাকাবাসী ব্যানার টানিয়েছে। তাদের দাবি, দূষিত কেমিক্যালযুক্ত পানি নদীতে ফেলা যাবে না। বর্জ্য পরিশোধন না করে ফেলা যাবে না। এলাকাবাসীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল ভেতরে ঢুকে কিছুটা যেতেই বাতাসে দুর্গন্ধ পাওয়া গেল। ঢাকা হাইড লেদারের পাশে দেখা গেল বিষাক্ত পানি ও বর্জ্যে আটকে আছে উন্মুক্ত ড্রেন। এর ডান পাশ ধরে এগোলে সড়কের মাথায় মারসন্স ট্যানারির কারখানা। সেখানে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। এ ট্যানারির পাশের ড্রেন বর্জ্যে ভরে আছে। এর একটু সামনে ইস্ট এশিয়া, এফ কে ও মদিনা ট্যানারির সামনের সড়কে তরল বর্জ্যের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। ম্যানহোলের ঢাকনা উপচে বর্জ্য পড়ছে সড়কে।

মদিনা ট্যানারি থেকে নবারুণ ট্যানারি হয়ে সিইটিপি পর্যন্ত প্রায় কয়েকশ’ গজ জুড়ে পুরো রাস্তায় ময়লা পানি জমে আছে। নবারুণ থেকে বামপাশের সড়ক হয়ে আজমেরী লেদার পর্যন্ত সড়ক বর্জ্যে ভরা। বেশিরভাগ সড়কে ময়লা পানি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সিইটিপির ভেতরে যেতেই দেখা যায়, দেশি ও চীনের শ্রমিকরা মাটি খুঁড়ে বর্জ্যের পাইপ বসানোর কাজ নতুন করে করছে। এ কাজ শেষ হলে দু’সপ্তাহ পরে সিইটিপিতে বর্জ্য শোধন করা যাবে বলে জানান তারা। সিইটিপির পাশ ধরে নদীর পাশে দেখা যায়, শিল্পনগরী থেকে পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে নীল রঙের তরল বর্জ্য। শ্রমিকরা জানান, এখন নদীতে না ফেললে পুরো ট্যানারি এলাকা তরল বর্জ্যে ডুবে যাবে। এ কারণেই নদীতে ফেলা হচ্ছে। এখন পরীক্ষামূলকভাবে মাঝে মধ্যে সিইটিপিতে পাম্পের সাহায্যে ড্রেনের পানি নেওয়া হচ্ছে। তাতে কাজ হচ্ছে না।

তারা জানান, শুরুতে ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন করার কথা তিনটি প্রাথমিক পরিশোধনাগারে ( ইপিএস)। এ পর্যন্ত একটি ইপিএস চালু হয়েছে। তাও বেশিরভাগ সময়ে বন্ধ থাকে। বাকি দুটি ইপিএস চালুর প্রস্তুতি চলছে। মদিনা লেদারের তত্ত্বাবধায়ক মো. হাবিবুর রহমান জানালেন, গত ঈদুল আজহার সময়ে সাভারে তাদের কারখানা চালু করা হয়। তখন এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। এরপর কিছুদিন বন্ধ ছিল। রোববার আবার চালু করতেই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ড্রেনে ময়লা পানি আটকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হাজারীবাগের চেয়ে এখানে আরও খারাপ অবস্থা হবে। ট্যানারির একটি ড্রাম থেকে একসঙ্গে প্রায় ৭ হাজার লিটার ময়লা পানি প্রবাহিত হয়। তবে পানি ব্যবস্থাপনার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখানে নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে সিইটিপির অর্ধেক অংশ চালু রয়েছে। তাও চলছে পরীক্ষামূলক। তিনটি ইপিএস পুরোপুরি চালু হয়নি। ৩০টি ট্যানারি কারখানা চামড়া উৎপাদন কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করায় ৫০টি ট্যানারি কারখানা দ্রুত চালু হবে। এ পর্যন্ত ১২৯টি ট্যানারি স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আবেদন করেছে।

মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থার (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেন, হাজারীবাগে যাতে দূষণ বন্ধ হয় সে জন্যই সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনগণের এত টাকা ব্যয় করে স্থানান্তরের পরেও দূষণ কেন হবে তা বোধগম্য নয়। দূষণ রোধে চামড়া শিল্পনগরীর সব কারখানা আপাতত বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেই ট্যানারি চালু করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার চেয়েও ধলেশ্বরী উজানের দিকে। এ নদীর পানি আরও দ্রুত নষ্ট হবে। তাই আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, সিইটিপি চালুর বিষয়টি নতুন অভিজ্ঞতা। এ কারণে শুরুর দিকে কিছু ত্রুটি হতে পারে। এসব ত্রুটি সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করা হচ্ছে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ভালোভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দ্রুত শেষ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকর হলে সব ট্যানারি গেলেও সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। এর পরেও কোনো বর্জ্য ফেললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চামড়াশিল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল কাইয়ুম সমকালকে বলেন, দুটি ইপিএস দিয়ে বর্জ্য সংশোধন চলছে। একটি ইপিএসের সঙ্গে বর্জ্যের সংযোগ দিতে কিছুদিন সময় লাগবে। এখন সড়কে কিছু ময়লা পানি উঠেছে। এটা সমাধানে চেষ্ট চলছে। এখন পরীক্ষামূলক হলেও জানুয়ারিতে চূড়ান্তভাবে বর্জ্য পরিশোধনের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, এখন সামান্য ত্রুটি হলেও হাজারীবাগের মতো অবস্থা হওয়ার কোনো কারণ নেই। সব ট্যানারি যাওয়ার আগে বর্জ্য পরিশোধনের সব প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। সব ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো পরিকল্পনা নিয়েই সিইটিপি করা হয়েছে।

ট্যানারি মালিকরা যা বলেন: বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ সমকালকে বলেন, পরিবেশের নিরাপত্তা নিয়েই এত আলোচনার পরও শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতি দুঃখজনক। সিইটিপির প্রক্রিয়া শেষ করে সব ট্যানারি স্থানান্তর করা উচিত ছিল। ডিসেম্বরের পরে ৭০ থেকে ৮০টি ট্যানারি চালু হওয়ার কথা। সিইটিপির কাজ শেষ না হলে তখন ভীষণ দুরবস্থা হতে পারে। বিদেশি ক্রেতাদের স্থায়ীভাবে হারাতে হবে। এ জন্য আগেভাগেই পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এখন যেসব ত্রুটি দেখা দিয়েছে, সব ট্যানারি চালু করার আগেই তার সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সমকালকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে সিইটিপি চালু করায় ত্রুটি হচ্ছে। অনেক বিষয় আগে জানা না থাকায় পদক্ষেপ নিতে পারেনি বিসিক। তিনি বলেন, সাভারের ট্যানারিতে হাজারীবাগের মতো অবস্থা হলে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা আর পাওয়া যাবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দেওয়া উচিত। এখন ৩০ ট্যানারিতে এ অবস্থা হলে সব ট্যানরি চালু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

ফরচুন লেদারের চেয়ারম্যান ও বিএফএলএলএফইএর সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবু তাহের সমকালকে বলেন, ইপিএসের সঙ্গে বর্জ্য লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়নি। এ কারণে রাস্তায় বর্জ্য পড়ছে। বর্জ্য পানি পরিশোধন প্রক্রিয়া পুরোপুরি চালু হয়নি। এভাবে পরিবেশ দূষণ হলে চীনা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে না হলে নতুন শিল্পনগরীরও হাজারীবাগের মতো অবস্থা হবে। এটা দ্রুত সমাধান করা উচিত। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর না করায় মালিকদের জরিমানা দিতে হচ্ছে। তাহলে ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে কেন চীনা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হচ্ছে না- এ প্রশ্ন তার।