একক দেশ হিসেবে রফতানি আয়ের সর্ববৃহৎ গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ১৬ শতাংশই আসে দেশটি থেকে। চলতি বছর দেশটি থেকে আসা রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে। পর পর দুই বছরের প্রথম নয় মাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১ শতাংশ থেকে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অধীন সেনসাস ব্যুরো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সর্বশেষ তারা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের বাণিজ্য তথ্য হালনাগাদ করেছে। প্রকাশিত এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বা পণ্য রফতানি বাবদ বাংলাদেশের আয় বেড়েছে। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম নয় মাসে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের আলোচ্য নয় মাসে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বা বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছে ৪৬৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। ২০১৫ সালের আলোচ্য সময়ে আয় হয় ৪৬০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এ হিসাবে আয়ের প্রবৃদ্ধি দশমিক ৬৬ শতাংশ। এদিকে ২০১৪ সালের নয় মাসে দেশটি থেকে আয় হয় ৪১৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এ হিসাবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে আয় ১১ শতাংশ বেশি হয়। এ হিসাবেই এক বছরের ব্যবধানে আয়ের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ থেকে ১ শতাংশের নিচে নেমে হয়েছে দশমিক ৬৬ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ পোশাক রফতানি হয়। এছাড়া অন্যান্য রফতানি পণ্যের মধ্যে আছে হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঁচা পাট, পাটজাত পণ্য ও বাইসাইকেল। অন্যদিকে দেশটি থেকে আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মধ্যে আছে নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর, তুলা, ইলেকট্রিক্যালসহ আরো কিছু পণ্য।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানি আয় কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের মৌসুম চলছে। বরাবরই এ সময়ে আয়ের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এর পাশাপাশি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে আছে, ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়া। এর প্রভাবে অনেক ক্রয়াদেশ ভারত, ভিয়েতনামে চলে গেছে।
শ্রম অধিকার ইস্যুতে ২০০৮ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) বন্ধ করতে তত্পর ছিল আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। এর পর ২০১২ সালে তাজরীন ও ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় শ্রম নিরাপত্তা। মার্কিন সরকারের উদ্যোগে তাত্ক্ষণিকভাবে স্থগিত হয় বাংলাদেশের জিএসপি। এর পর ২০১৫ সালে সব দেশের জন্য নতুন জিএসপি স্কিম চালু হলেও সুবিধাপ্রাপ্তদের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। এ নিয়ে উদ্বেগ ছিল না রফতানিকারকদের। কারণ, রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, জিএসপি সুবিধার আওতায় না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পোশাক রফতানি আয় বেড়েছে। আস্থাও আগের তুলনায় আরো বেড়েছে। তবে সব দিক থেকে ক্রেতাপক্ষই বেশি লাভবান হয়েছেন। আর পোশাক সরবরাহকারী কারখানা মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ কারখানার কমপ্লায়েন্স ব্যয়, জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যও কমেছে। আর কমপ্লায়েন্সসহ এসব ইস্যুতেই ক্রেতারা পণ্যের মূল্য আরো কমিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মুদ্রার বিনিময় হার ও দেশটির নির্বাচনের মৌসুম।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায় না। সিংহভাগ আয়ও আসে এ পণ্যটির রফতানি থেকে। মূলত এ কারণেই প্রত্যক্ষ কোনো নেতিবাচক প্রভাব রফতানি আয়ে পড়েনি। তবে এখন টাকার বিপরীতে ডলারের অবমূল্যায়নে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে রফতানি আয়ে। আবার কমপ্লায়েন্স, পণ্যমূল্য এমন কারণগুলোও প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিতে পারে।
রফতানি খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গত এক বছরে দেশে তৈরি পোশাকের উত্পাদন ব্যয় বেড়েছে গড়ে ১০ শতাংশ। তবে পোশাকের রফতানি মূল্য ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা কমিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশটিতে বাংলাদেশী পোশাকের মূল্য কমেছে। আর সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলেছে ডলার ও ইউরোর বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ার বিষয়টি। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি।