Home বাংলা নিউজ পোশাক কারখানা: সেলাই মেশিন থেকে নেতৃত্বে উঠে আসছেন নারীরা

পোশাক কারখানা: সেলাই মেশিন থেকে নেতৃত্বে উঠে আসছেন নারীরা

পোশাক কর্মী নুরুননাহার বেগম কখনও হয়ত কল্পনাও করেননি তিনি এমন দায়িত্ব পাবেন। সচরাচর পুরুষ সহকর্মীদেরই দেখে এসেছেন এসব পদে কাজ করতে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কারখানাতে এখনও চলছে তাই।

তার মত নারীদের পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পাওয়া অনেকটা ব্যতিক্রমই। কারখানায় এমন নেতৃত্বের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে পাওয়া তাই তার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়ই।

চাকরিতে যোগ দেওয়ার চার বছরের মাথায় ২০১৬ সালে নুরুননাহার সুপারভাইজারের দায়িত্ব পান। নতুন পদবিতে তিনি দেখভাল শুরু করেন ৩০ জন কর্মীর একটি দলকে, যারা কাপড়ের গুণগত মান যাচাই বাছাই করে। ঢাকার পোশাক কারখানায় তখনকার সময়ে এমন ঘটনা ঘটেছে কদাচিৎ। ২৮ বছর বয়সী এই নারী ২০১২ সালে যোগ দিয়েছিলেন সেলাই কর্মী হিসেবে।

প্রথা ভেঙ্গে তাকে এমন দায়িত্ব দেয় ডিবিএল গ্রুপ। দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠানটি এইচ অ্যান্ড এম ও ওয়ালমার্টের মত ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরি করে থাকে।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর অর্ধেকের বেশি সেলাই মেশিন অপারেটর নারী। অথচ তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়কদের ৯০ শতাংশ পুরুষ। গবেষকদের মতে, এ লিঙ্গ বৈষম্য কর্মীদের কাজে যেমন বিরূপ প্রভাব ফেলে, তেমনি উৎপাদনশীলতাকেও ব্যাহত করে বলে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ৪০ লাখ কর্মীর তৈরি পোশাক খাতের এই ‘মাইন্ডসেট’ পাল্টাতে এক যুগ ধরে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা ও কারখানা মালিকরা।

করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সচল ঢাকার মিরপুরের একটি পোশাক কারখানা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিকরপোরেট ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, পোশাক খাত যখন পরিবেশবান্ধব ও উচ্চ প্রযুক্তির বিজনেস মডেলমুখী হয়ে পড়ছে, তখন নারীদের আরও অধিক দায়িত্বশীল পদে কাজ দেওয়া এবং উচ্চ বেতনের চাকরিতে নিয়োগ তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

নুরুননাহার বেগমের পদোন্নতি এমন একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ইতিবাচক ফল। ডিবিএল গ্রুপে যোগ দেওয়ার দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন কিছু দিন পরপরই তাদের দলের তত্ত্বাবধায়ক বদল হচ্ছে। এর কারণ আর কিছুই নয় তাদের খারাপ পারফরমেন্স।

এমন অবস্থায় আত্মবিশ্বাসী এই কর্মী এই কাজ করত পারবেন বলে কারখানা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কর্তৃপক্ষই বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই নিল। কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর তিনি নতুন এই পদের যোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুললেন এবং কাজটি পেলেন। সেই থেকে তিনি এখন পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

“পোশাক কারখানার সুইং লাইনের অধিকাংশ কর্মী নারী বলে একজন নারীকে একটি টিমের দায়িত্ব দেওয়া হলে তা বেশি কার্যকর হয় বলে আমি মনে করি। কেননা একজন নারীর কাছেই নারী কর্মীরা তাদের সুখ দু:খ সহজেই তুলে ধরতে পারেন বলে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন নুরুননাহার।

তিনি বলেন, “উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পিরিয়ডের সময় একজন নারীর পেট ব্যথা হলে তিনি তা পুরুষ তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে শেয়ার করতে চান না। এর বদলে হয়ত কাজেই অনুপস্থিত থাকেন, যা উৎপাদনককে ব্যাহত করে। এমন ক্ষেত্রে আমি সহকর্মীদের আগে ছুটি দিয়ে দেই অথবা বলি বিরতি নিতে- যা উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে বিঘ্ন ঘটায় না।“

সফল উদাহরণ

রয়টার্স লিখেছে, ২০১৭ সালে ডিবিএল গ্রুপে নারীদের নেতৃত্বে থাকা ৪২টি টিমের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, এসব দলের কর্মীরা উৎপাদনশীলতায় পুরুষ তত্ত্ববধায়কদের আওতাধীন দলগুলোর চাইতে ৩ শতাংশ বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছেন। এতে কারখানাটির বার্ষিক আয় বেশি হয়েছে ১৫ লাখ ডলার।

বর্তমানে রপ্তানিতে পোশাক খাতের নেতৃত্ব স্থানে থাকা শিল্পগ্রুপটির পাঁচটি সুইং লাইনের মধ্যে একটির দেখভাল করছেন

নারী সুপারভাইজার। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল একেবারে শুন্য।

মিরপুরে ১১ নম্বরে রোববার একটি পোশাক কারখানায় ঢুকছেন কর্মীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিডিবিএল গ্রুপের চিফ সাসটেইনেবিলিটি অফিসার মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ বলেন, “এটি (সমীক্ষা) আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রেরণা যোগায়। কেননা একটি ‘বিজনেস কেইসের’ সফল উদাহরণ এটি।“

এখন পর্যন্ত এ কারখানা কর্তৃপক্ষ ১০০ নারী সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ এখনও তাদের সঙ্গে রয়েছেন।    

“অন্যত্র চলে যাওয়া এসব সুপারভাইজারদের তথ্য থেকে দেখা যায় এই খাতে তাদের চাহিদা বাড়ছে, বলে উল্লেখ করেন জাহিদুল্লাহ।

রয়টার্স বলছে, উন্নয়ন সহযোগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত আরেকটি পৃথক কর্মসূচির ফলাফলেও ইতিবাচক তথ্য মিলেছে। ‘জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড রিটার্ন’- জিইএআর শীর্ষক ৬০ পোশাক কারখানায় কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর এ প্রশিক্ষণের পর নারী নেতৃত্বে থাকা সুইং লাইনগুলোর উৎপাদনশীলতা ৫ শতাংশ বেড়েছে।

“উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, রাজস্ব আয়ে ঊর্ধ্বগতি ও অনুপস্থিতি কমে যাওয়ার প্রবণতা কর্মী ও কারখানা উভয়ের জন্যই ফলদায়ক,” বলছেন নাবিরা রহমান, যিনি ইন্ট্যারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন- আইএফসি ও ইন্ট্যারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন- আইএলও পরিচালিত এ কর্মসূচির প্রধান।

জিইএআর এর ছয় মাসের কোর্স নারী কর্মীদের আত্মবিশ্বাসী হতে, চাপ সামলাতে এবং সহকর্মীদের সঙ্গে কিভাবে কার্যকরি যোগাযোগ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করেছে। এটি উৎপাদন পর্যায়ের বিভিন্ন বাধা ও সক্ষমতার হিসাব নিকাশের মত কারিগরি দক্ষতা বাড়াতেও ভূমিকা রেখেছে বলে বলছে রয়টার্স।

নুরুননাহারের মত কুলসুম বেগমও চলতি বছর সুপারভাইজারের দায়িত্ব পান। এর আগে ঢাকার সেই কারখানায় তিনি ১০ বছর সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করেন।

তিনি বলেন, “আগের সুপারভাইজাররা যেসব ভুল করতেন তিনি তা বুঝতে সক্ষম হন ব্র্যাক পরিচালিত এমন একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে।

“যখন কেউ ভুল করে তখন কিভাবে শান্ত থাকতে হয় এবং ঠাণ্ডা মাথায় ওই ব্যক্তির ভুল ধরিয়ে দিতে হয় তা আমি প্রশিক্ষণ থেকে শিখেছি। অনেক পুরুষ সুপারভাইজারদের দেখেছি কেউ ভুল করলে তারা কিভাবে চিৎকার করে উঠতেন,“ ব্যাখ্যা করেন তিনি।  

সামাজিক বাধা

এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তৈরি পোশাক খাতে নারী সুপারভাইজার সামান্য বাড়লেও এ পরিবর্তনটুকুর জন্যও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়।

২০১৮ সালে ডিবিএল এ আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায়, কিছু সংখ্যক নারী কর্মী বলেছেন তারা নারী সুপারভাইজারদের অধীনে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে তারা পুরুষ তত্ত্বাবধায়কের কথা বেশি মেনে থাকেন।

রয়টার্সএ বিষয়ক সাক্ষাৎকারে মেশিন অপারেটররা বলেন, পুরুষ তত্ত্বাবধায়করা অনেক সমস্যার সমাধানে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে নারী ‘বস’রা এই বিষয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রথমে পরামর্শ করতে চান।

“নারী ব্যবস্থাপনার যেতে এই রূপান্তরের পথে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, বিশেষ করে প্রডাকশন ফ্লোরে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখে। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং নারী কর্মীদের সহযোগিতার মাধ্যমে ইতিবাচক এই পরিবর্তন সম্ভব,” বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়।

ব্র্যাকের সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড সেফগার্ডিং এর প্রধান জেনিফা জব্বার বলেন, নারী তত্ত্বাবধায়কদের উৎসাহিত করতে আরও অনুকূল পরিবেশ দরকার।

শ্রমিক নেতা ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়াকার্স সলিডারিটির প্রধান কল্পনা আক্তার চান সরকার প্রতিটি কারখানায় যেন নারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে একটি নির্দিষ্ট কোটা চালু করে।

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত?

এ বিষয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নারী কর্মীদের নেতৃত্বে আনার এমন রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ভিত্তি গড়ে দিতে পারে। পোশাক কারখানাগুলো উচ্চ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণে এসব কর্মীদের অনেকেই চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি ওয়ার্নার বলেন, একজন নারী ৩০ বা এর অধিক কর্মী ব্যবস্থাপনা করার শিক্ষা পেলে তাদের দক্ষতা অন্য খাতেও স্থানান্তর করা সম্ভব।

“(জিইএআর) এমন একটি কর্মসূচি যা নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মত দায়িত্ব নিতে তৈরি করে। যে কারখানায় তারা এমন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন সেটির বাইরেও অন্য কারখানায় কিংবা তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতেও কাজ করার যোগ্য হবেন।“

ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার বলেন, আরও টেকসই ব্যবসা মডেলে যাওয়ার বেলায় সাময়িক কিছু বাধা তৈরি করলেও দক্ষ প্রশিক্ষণ এমন প্রভাব কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 

রয়টার্স লিখেছে, উদাহরণ হিসেবে পদোন্নতির পর কুলসুম বেগমের মাসিক বেতন ১৩৫ থেকে ২৩৫ ডলারে উন্নীত হয়। এতে তার চার সদস্যের পরিবার একটি আলাদা কক্ষ ভাড়া নিতে সক্ষম হয়। এতদিন তারা এক রুমেই থাকতেন।  

এটি ৩৫ বছরের এই কর্মীকে আরও বড় স্বপ্ন দেখায়, যা কর্মক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

“শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার পরও ১০ বছর পর আমি সুপারভাইজার হতে পেরেছি। এখন আমার লক্ষ্য আরও উপরে যাওয়া। আমি এখন কন্ট্রোলার বা লাইন ম্যানেজার হতে চাই। যদি পুরুষরা পারে তাহলে আমি কেন পারব না।“

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here