Home বাংলা নিউজ তেতে উঠেছে বৈশ্বিক পণ্যবাজার, চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি

তেতে উঠেছে বৈশ্বিক পণ্যবাজার, চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি

করোনার আগেও বিশ্ববাজারে তুলার দাম ছিল প্রতি পাউন্ড প্রায় ৬৫ সেন্ট। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ ডলার ১০ সেন্টেরও বেশিতে। পণ্যটির ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্প-সংশ্লিষ্টরা। এ শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য সুতার দাম লাগামহীন হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। এখনই দরকষাকষিতে সতর্ক না হলে ক্রেতাদের অভিহিত মূল্যে পণ্য রফতানি করতে গিয়ে রফতানিকারকরা বিপাকে পড়তে পারেন বলে মনে করছেন তারা।

শুধু তুলা নয়; শিল্প খাতের কাঁচামাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের প্রায় প্রতিটিরই আন্তর্জাতিক বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সার্বিকভাবে দেশের আমদানি খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তাব্যয়েও ব্যাপক উল্লম্ফনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ উদ্বেগকে আরো জোরালো করে তুলেছে বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার অস্থিতিশীলতা। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদন, পরিবহন ও গৃহস্থালি পর্যন্ত অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি।

আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখন টান পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। সার্বিকভাবে দেশের গোটা অর্থনীতিতেই এখন বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে মূল্যের বর্তমান গতি।

কভিডের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের মূল্য ছিল ২০০ ডলারের ঘরে। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে বর্তমানে তা টনপ্রতি ২৬৫ ডলার ছুঁয়েছে। একই সময়ের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৭৭৩ থেকে বেড়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতিদিনই এসব পণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীন গতিতে।

আন্তর্জাতিক বাজারের এ অস্থিতিশীলতা এখন বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়কেও উসকে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। গত অর্থবছর (২০২০-২১) দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধিতে যে উল্লম্ফন চলছে, সেটি পণ্য আমদানির পরিমাণের প্রবৃদ্ধি নয়। বরং বিশ্ববাজার থেকে উচ্চমূল্যে ভোগ্যসহ অন্যসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে গিয়েই দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এক্ষেত্রে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির তুলনায় ভোগ্য ও জ্বালানি পণ্যের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই ভূমিকা রাখছে বেশি। বাজারের এ অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দামে যে অস্থিরতা চলছে, তাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। কেন হঠাৎ করে পণ্যের দাম বাড়ছে, সেটি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। পৃথিবীকে নিয়ে যারা খেলাধুলা করতে পছন্দ করে, এটি তাদের গেম প্ল্যানও হতে পারে। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো হয়তো অদূরভবিষ্যতে ভোগ্যপণ্যের নাজুক কোনো পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছে। এজন্য তারা এসব পণ্যের মজুদ বাড়াচ্ছে। আমাদের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারের তুলনায় আমরা খুবই ছোট একটি দেশ। বেশির ভাগ পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে অবস্থান এখনো দিনে এনে দিনে খাওয়ার পর্যায়ে। জ্বালানি ও ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের সামর্থ্য আমাদের এখনো হয়নি। তবে এসব ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ভবিষ্যতের স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন বলেই আমি মনে করি।

বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, করোনা শুরুর আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন চালের মূল্য ছিল ৪২৪ ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যটির দাম ৪৮৪ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনির দাম ছিল মাত্র ২৪ সেন্ট। চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রতি কেজি চিনির দাম ৩৭ সেন্ট পর্যন্ত উঠেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার সব বাজার আদর্শেই পণ্যটির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮০ ডলারের কাছাকাছি বা এর চেয়েও বেশিতে। সার্বিকভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যস্তর এখন সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে। তবে দ্রুতই এ ঊর্ধ্বগতি থামবে না বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বাজার পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, কয়েক মাসের মধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদিও ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম নেমে এসেছিল মাত্র ৩১ ডলারে।

অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামের মতোই অস্থিরতা চলছে এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজারে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আকস্মিকভাবে পণ্যটির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৫৬ ডলার অতিক্রম করে। যদিও পরে তা ৩৫ ডলারে নেমে এসেছে। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারিতেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল মাত্র ১৪ ডলার।

রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল তুলার আন্তর্জাতিক বাজার এখন সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে তুলার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাউন্ডপ্রতি ১ ডলার ১০ সেন্টের কিছু বেশিতে। করোনার আগেও তা ছিল প্রায় ৬৫ সেন্ট। সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং মিল মালিকরা বলছেন, তুলার দাম এখন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর প্রভাবে আগামী মাসে সুতার দাম অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা।

এ বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, তুলার দাম গত এক দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা যাবে আগামী নভেম্বর নাগাদ। এ পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম নিয়ে দরকষাকষিতে পোশাক শিল্প মালিকদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ আমাদের শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে সুতার দাম বেড়ে যেতে পারে।

বিশ্ববাজারের চেয়েও অস্বাভাবিক হারে ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে বাংলাদেশের বাজারে। গত এক বছরে দেশে ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙেছে। গতকালের বাজারেও সবচেয়ে কম দামি ভোজ্যতেল পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) প্রায় ৫ হাজার টাকায়। প্রায় এক দশক আগে দেশে চিনির দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছিল। সম্প্রতি চিনির দামও সেই রেকর্ড ভেঙে মণপ্রতি ২ হাজার ৮০০ টাকায় পৌঁছেছে। তাছাড়া গমের দাম মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে মণপ্রতি ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এমএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন মিন্টু বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে কমোডিটি পণ্যের বুকিং বৃদ্ধির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়া। তাছাড়া পণ্য আমদানিতে আগের তুলনায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় হচ্ছে। আগে প্রতিটি এলসি (ঋণপত্র) খোলার পর এক-দেড় মাস সময় লাগত পণ্য দেশে পৌঁছতে। বর্তমানে সময় লাগে আড়াই-তিন মাস। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী কনটেইনার সংকট, বাল্কে পণ্য আমদানিতে জটিলতা দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে গতকাল প্রতি মণ পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯৬০ টাকায় (মিল থেকে সরাসরি উত্তোলনযোগ্য)। ১৫ দিনের ব্যবধানে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। তাছাড়া সুপার পাম অয়েলের দাম প্রায় সমপরিমাণ বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকায়। আর সয়াবিন তেল ৫ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে চিনির দাম মণপ্রতি ১৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৮২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। এছাড়া দুই মাসের ব্যবধানে গমের পাইকারি দাম মণপ্রতি প্রায় ৫০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকায় (কানাডিয়ান)। আর নরম-জাতীয় গম (ভারত, রাশিয়া) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকা মণ দরে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব পণ্য আমদানিনির্ভরশীল সেসব পণ্যের মূল্য নিয়মিত পর্যালোচনা করে ট্যারিফ কমিশন। কমিশনের দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করছি।

হঠাৎ করেই দেশের আমদানি ব্যয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হওয়ায় টান পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দামও বেড়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৮০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ৮০০ কোটি ডলার বাজার থেকে কিনে নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার থেকে কিনে নেয়া ডলারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তরতর করে বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। সর্বশেষ ৬ অক্টোবর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভ নিয়ে এখনো উদ্বেগে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হলেও বাজার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়ায় রফতানি বাড়বে। রফতানি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব হবে। বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্যে যে অস্থিরতা চলছে, তা দীর্ঘমেয়াদি নাও হতে পারে। সব মিলিয়ে নিকট ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় কোনো চাপ আসবে বলে মনে হয় না। তার পরও ভোগ্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতির ওপর আমাদের নীতিনির্ধারকদের নজর রাখতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here