উজ্জ্বল
আলোর নিচে লাইন ধরে বসানো সারি সারি সেলাই মেশিন। কাজ করছেন শত শত নারী শ্রমিক।
বাংলাদেশের যেকোনো গার্মেন্ট কারখানার চিরচেনা দৃশ্য। এখনো হয়ত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা চট্টগ্রামের বড় বড় কারখানায় এমন দৃশ্য দেখা
যাবে। কিন্তু ১০ বছর পরের দৃশ্য কল্পনা করা যাক। কেমন হবে তখন বাংলাদেশের একটি
পোশাক কারখানা? নিউইয়র্কের শিমি টেকনোলজি
নামের একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সারাহ ক্রেসলির কাছে ভবিষ্যতের
ছবিটা পরিষ্কার। ‘১০ বছর পরের
পোশাক কারখানায় খুব অল্প শ্রমিকই আসলে কাজ করবেন। রোবটিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি
তখনো আমরা হয়ত কিছু কর্মীকে কাজ করতে দেখব। কারখানাজুড়ে তখন বেশি থাকবে বিভিন্ন
ধরনের স্বয়ংক্রিয় রোবটিক যন্ত্রপাতি। থাকবে অনেক কম্পিউটার। কারখানার বড় অংশজুড়ে
থাকবে ডিজাইন রুম। বেশিরভাগ কর্মী কাজ করবে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে।’ সারাহ ক্রেসলি এর আগে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অটোমোবাইল
বা গাড়ি নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে। যেভাবে অটোমেশন গাড়ি নির্মাণ শিল্পকে পাল্টে
দিয়েছে,
এবার পোশাকশিল্পে এরই পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে বলে মনে করেন
তিনি। যে শিল্পে বাংলাদেশে কাজ করে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ, গত কয়েক দশক ধরে যে খাতে তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বেশি কাজ, তার অবস্থা তাহলে কী দাঁড়াবে? ‘তাদের ৬০-৮৮ শতাংশ কাজ হারাবে অটোমেশনের কারণে। অর্থাৎ লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হবে। এটা আমার হিসাব নয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাব’, বলেন সারাহ ক্রেসলি। তার মতে, বাংলাদেশের সামনে বিপদ অনেক রকমের। প্রথমটা হচ্ছে এই অটোমেশন, যেটা ইতোমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় হচ্ছে সোশ্যাল
মিডিয়ার প্রভাবে বদলে যাওয়া ফ্যাশন ট্রেন্ড, যেটা বিরাট প্রভাব ফেলছে পোশাকের ব্রান্ডগুলোর ওপর। আর সবশেষে আছে অটোমেশনের
চূড়ান্ত ধাপে পোশাকশিল্পের ‘রিশোরিং’ বা ‘নিয়ারশোরিং’। অর্থাৎ যেখান থেকে এই পোশাকশিল্প বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এসেছে, এই শিল্পের সেখানেই ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি।
ভবিষ্যৎ কী : যে দেশের
অর্থনীতির
প্রধান ইঞ্জিন হয়ে উঠেছে এই পোশাকশিল্প, তার ভবিষ্যৎ তাহলে কী? ব্যাপারটা নিয়ে কি আসলেই নড়ে-চড়ে বসার সময় এসেছে? বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন
ফজলুল হক। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি। পোশাকশিল্প খাতে অটোমেশনের যে ঝুঁকির কথা বলা
হচ্ছে,
সেটিকে তিনি বিপদ হিসেবে দেখতে রাজি নন। তবে অটোমেশন যে এরই
মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, সেটা স্বীকার
করলেন তিনি। ফজলুল হক বলেন, ‘একটা মাঝারি
আকারের কারখানার কাটিং সেকশনে ১৫০-২০০ লোক লাগত, সেখানে এখন অটোমেটিক কাটিং মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে শ্রমিক লাগে ১০-১২ জন। অর্থাৎ ১০ ভাগের এক ভাগ লোক লাগে। এ রকম অটোমেশন কিন্তু চলছেই। আগামী ১০ বছরে এই শিল্পে যে বিরাট
পরিবর্তন ঘটবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ তবে ফজলুল হক বলছেন, বাংলাদেশে অটোমেশনের কারণে যত লোক কাজ হারাচ্ছেন, তাদের আবার এই শিল্পেই কোনো না কোনোভাবে কর্মসংস্থান হয়ে
যাচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশে এখনো এই শিল্পের
আকার বাড়ছে। এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলেন গার্মেন্টশ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার।
ট্রেড ইউনিয়ন করতে প্রতিদিন নানা ধরনের কারখানায় তার যাতায়াত। অটোমেশন যে
শ্রমিকদের কাজ কেড়ে নিচ্ছে, সেটা তিনি নিজ
চোখেই দেখতে পান প্রতিদিন।
রোবট আসছে!
‘বাংলাদেশে এখন যত বড় ফ্যাক্টরি আছে, বিশেষ করে এ এবং বি ক্যাটাগরির যত ফ্যাক্টরি, সেখানে অনেক নতুন মেশিন আনা হয়েছে। এসব মেশিনে এমন বহু কাজ হচ্ছে, যেগুলো আগে শ্রমিকদের করতে হতো।’ ‘সূতা কাটা, আয়রন করা, কাটিং, ড্রয়িং, লে-আউট, লোডিং-আনলোডিং- কোনো কাজই এখন মেশিন করছে না। বিভিন্ন ধরনের
মেশিন চলে আসছে, যেখানে আর আগের মতো
শ্রমিকের দরকার হচ্ছে না,’ বলছেন তিনি। বাংলাদেশের
গার্মেন্ট খাতে এই পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ৩-৪ বছর আগে থেকে। এই খাতের একজন
শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা ফজলুল হক জানালেন, তিনি নিজের কারখানাতেও এ রকম প্রযুক্তি চালু করেছেন।
‘কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের প্রতিটি কারখানায় বেশিরভাগ মেশিনে দুইজন করে লোক
লাগত। একজন মেশিন চালাতেন, আরেকজন
উল্টাদিকে বসে সাহায্য করতেন। গত ৩-৪ বছরে পর্যায়ক্রমে হেলপারের পদ খালি হয়ে গেছে।
মেশিন ওই জায়গা দখল করে নিয়েছে।’ একটি মাঝারি
মাপের কারখানার কাটিং বিভাগে আগে প্রায় ১৫০-২০০ কর্মীর দরকার হতো। সেখানে এখন
অটোমেটিক কাটার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে মাত্র ১০-১২ জন লোক দিয়েই কাজ চালানো যায়। অর্থাৎ ১০ ভাগের এক ভাগ লোক দিয়েই এখন কাজ চালানো যায়। ফজলুল হক
বলেন,
বাংলাদেশের প্রতিটি কারখানাই এখন কম-বেশি এ রকম অটোমেশনের
ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পে কী ধরনের মেশিন বা যন্ত্রপাতি
আমদানি করা হচ্ছে, তা নিয়ে একটি
সমীক্ষা চালিয়েছে ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। প্রতিষ্ঠানটির ফেলো অর্থনীতিবিদ
ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, একটা পরিবর্তন
যে শুরু হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। ‘আগে যে ধরনের মেশিন আমদানি করা হতো, এর চেয়ে অনেক ভিন্ন ধরনের মেশিন এখন আনা হচ্ছে। অনেকে রোবটও
আনছেন। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে।’ ড. রহমানের মতে, এর একটা কারণ
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসলে তখন আর বিনা শুল্কের সুবিধা
পাবে না। তখন তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। তখন কারখানা মালিকরা প্রযুক্তির দিকেই ঝুঁকবেন।
কমছে নারী শ্রমিক
গার্মেন্ট
নেত্রী নাজমা আক্তার বলছেন, মালিকরা নতুন
প্রযুক্তির ব্যাপারে এত আগ্রহী হওয়ার কারণ, এটি তাদের আরও বেশি মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে। ‘গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, তারা বলে চারটা লোক যে কাজ করে, একটা মেশিনেই এখন সেই কাজ হয়। একজন শ্রমিককে নূ্যনতম আট হাজার টাকা মজুরি দিতে
হয়। চারজন শ্রমিকের পেছনে যায় প্রায় ৩২ হাজার টাকা। কিন্তু এখন নাকি আট হাজার
টাকাতেই একটি মেশিন পাওয়া যায়। কাজেই মালিকরা সেই পথেই যাচ্ছেন।’ নাজমা আক্তারের মতে, অটোমেশনের প্রথম শিকার হচ্ছেন কারখানার নারী শ্রমিকরা। ‘অনেক কারখানাতেই যেখানে এক হাজার শ্রমিক ছিল, এখন সেখানে হয়ত বড়জোর ৩০০ শ্রমিক আছে। বেশিরভাগ জায়গায় নারী
শ্রমিকরাই কাজ হারাচ্ছেন।’ তবে
পোশাকশিল্প উদ্যোক্তা ফজলুল হক মনে করেন, এ রকম আশঙ্কা তিনি দেখছেন না। ‘যেটা বলা হচ্ছে, রোবট এসে সব
দখল করে নেবে এবং এর ফলে এই শিল্প আর বাংলাদেশে থাকবে না, ইউরোপ-আমেরিকাতেই ফিরে যাবে। কিন্তু এ কথার মধ্যে আমি একটা
ফাঁক দেখছি। মানুষের জায়গায় রোবট বসালে তার খরচ কী দাঁড়াবে এবং সেই বিনিয়োগ সবাই
করতে পারবে কিনা বা এই রোবটের অপারেশনাল খরচ কী হবে- এগুলোর কোনো পরিষ্কার জবাব
কিন্তু এখনো আমি কোনো স্টাডিতে দেখিনি।’ অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন, এই শিল্পকে বাংলাদেশে ধরে রাখার সুযোগ এখনো আছে।
কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ
কিন্তু
এই যে বিরাট প্রযুক্তিগত পরিবর্তন গার্মেন্টশিল্পকে আমূল বদলে দিচ্ছে, সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কতটা প্রস্তুত
বাংলাদেশ?
শিমি টেকনোলজিসের সারাহ ক্রেসলি বলছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের সামনে কোনো বিকল্প
নেই। তার আশঙ্কা, যদি এর পেছনে
সত্যিকারের কোনো বিনিয়োগ করা না হয়, বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। তখন এসব প্রতিষ্ঠান অন্যান্য পোশাক রপ্তানিকারক দেশে
চলে যাবে। ‘কিন্তু আমি আসলে চাই না এটা
ঘটুক। আমি দেখেছি, বাংলাদেশ গত
পাঁচ বছরে কত ধরনের কাজ করেছে। আমি গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছি।
কারখানাগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য তারা কত কাজ করেছে, সেটা আমি দেখেছি। আমি চাই, বাংলাদেশ পোশাক সরবরাহকারী দেশের শীর্ষে থাকুক। কিন্তু সে জন্য এই বিষয়টিকে
খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং আমি আশা করি, তারা সেই সিদ্ধান্ত নেবে।’ সারাহ
ক্রেসলির প্রতিষ্ঠান মূলত গার্মেন্টশিল্পকে অটোমেশনের যুগের জন্য প্রস্তুত হতে
সাহায্য করে। গত প্রায় ছয় বছর ধরে এই কাজেই তিনি বাংলাদেশে যাতায়াত করছেন। সেখানে
তার প্রতিষ্ঠান পাঁচটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের
প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাংলাদেশে সর্বশেষ সফর থেকে নিউইয়র্কে ফেরার পর তার সঙ্গে কথা
হচ্ছিল টেলিফোনে। ‘আমরা নিজেদের
একজন গার্মেন্টশ্রমিকের অবস্থানে রেখে কল্পনা করে এই কর্মসূচি তৈরি করেছি।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ গার্মেন্টশ্রমিকের খুব কমই আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ আছে। আমরা
আমাদের লার্নিং টুলগুলো তৈরি করেছি একটি গেমের মতো করে। আমরা একটি ভিডিও গেমের মতো
ইন্টারফেস তৈরি করেছি, তার সঙ্গে যোগ
করেছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’ ‘এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাংলা শেখানো হবে। ফলে কারখানার
কর্মীরা বাংলায় কথা বলে তাদের নির্দেশ দিতে পারবে এবং হাতের স্পর্শ দিয়েও এসব
মেশিন চালানো যাবে।’ শিমি
টেকনোলজিসের পাইলট প্রকল্পে গার্মেন্টের নারী কর্মীরা ডিজিটাল প্যাটার্ন মেকিংয়ের
বেসিকস শিখছে। শিখছে আরও নানা কিছু। এর মাধ্যমে গার্মেন্টকর্মীরা ডিজিটাল যুগের
জন্য তৈরি হয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি।