Home বাংলা নিউজ বিজিএমইএর অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গী ছিল রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো

বিজিএমইএর অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গী ছিল রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো

বিজিএমইএর অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গী ছিল রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো

বিজিএমইএ ভবনের জমিটি ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। এর স্বত্ব পাওয়ার আগেই বিজিএমইএর সঙ্গে এ জমি হস্তান্তরের চুক্তি করে বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি তাই বৈধ ছিল না বলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আর অবৈধ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা ওই জমির ওপরই নিজস্ব অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তোলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অর্থাত্ বেগুনবাড়ি খাল ও হাতিরঝিল লেকের ওপর বিজিএমইএ ভবন গড়ে তোলার যে অপকর্ম, তাতে সমর্থন জুগিয়েছে ইপিবি।

ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর লিভ টু আপিল খারিজ করে গত ২ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ। গত মঙ্গলবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে বলা হয়েছে, বিজিএমইএ কমপ্লেক্স কারওয়ান বাজারের ২৩/১ পান্থপথের লিংক রোডের যে জমিতে অবস্থিত, সেটি ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বরের আগে ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। জমিটি হস্তান্তরে ইপিবি ও বিজিএমইএর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০০১ সালের ৭ মে। আইনগতভাবে এ হস্তান্তর কোনোভাবেই বৈধ নয়। কারণ জমিটিতে ইপিবির বৈধ মালিকানা ছিল না। ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রেলওয়ে জমিটি ইপিবিকে হস্তান্তর করে। ফলে জমিটির বৈধ মালিক হওয়ার পাঁচ বছর আগেই ইপিবি ও বিজিএমইএর মধ্যে জমি হস্তান্তর সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে ‘ট্রান্সফার অব প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২’ ও ‘রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮’ লঙ্ঘিত হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী, যেহেতু জমিটির হস্তান্তরই আইনসিদ্ধ হয়নি, তাই ভবন নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) অন্যান্য কর্তৃপক্ষ থেকে নেয়া বিজিএমইএর ছাড়পত্রও বৈধ নয়। এ হিসাবে বিজিএমইএ ভবনটি শুধু অননুমোদিতই নয়, অবৈধও বটে।

‘ট্রান্সফার অব প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২’-এর ৫৩ সি ধারা, ‘রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮’-এর ৫২ ধারা ও জলাধার আইন, ২০০০-এর ৫ ধারা অনুযায়ী, ইপিবি ও বিজিএমইএর মধ্যকার জমি হস্তান্তর চুক্তিটি আইনের চোখে বিক্রি বা ইজারা কোনোটিই নয়। আদালতের মতে, বৈধ অধিকার ছাড়াই ভবনটি নির্মাণ শুধু অবৈধই নয়, এটি বিজিএমইএর ক্ষমার অযোগ্য জালিয়াতি ও ভয়াবহ প্রতারণা। ইপিবির এ অবৈধ হস্তান্তর ছাড়াও বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর ৩ ধারা অনুযায়ীও হাতিরঝিল লেক ও বেগুনবাড়ি খালে বিজিএমইএর ভবন নির্মাণ অবৈধ।

রায়ে আরো বলা হয়েছে, আলোচ্য জমিসহ আরো বেশকিছু জমি মূলত ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। এর মধ্যে ৫ দশমিক ৫৫ একর জমি বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মাধ্যমে ইপিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে এ জমি থেকে দশমিক ৬৬ একর ইপিবির মাধ্যমে ইজারা নেয় বিজিএমইএ, যার বিনিময়ে ইপিবিকে কিস্তিতে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ২৭৪ টাকা পরিশোধ করে সংগঠনটি। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে চিঠির মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে রাজউক বিজিএমইএকে ভবন নির্মাণের নকশার অনুমোদন দেয়। এর পর ২০০৬ সালের আগস্টে আরেক চিঠিতে বিজিএমইএকে অননুমোদিত অবকাঠামো সরিয়ে ফেলতে বলে রাজউক। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদনের আগে নির্মাণকাজ শুরু করায় বিজিএমইএকে সাড়ে ১২ লাখ টাকার জরিমানা করা হয়।

রাজউকের অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করছে উল্লেখ করে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনা হলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা হবে কিনা, তা জানতে চেয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন আদালত। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ৯০ দিনের মধ্যে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বিজিএমইএ ওই অপসারণের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে ওই বছর ৫ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন সে সময়ের চেম্বার বিচারপতি। পরবর্তীতে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো বাড়ান। পরে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেন, জমিটির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই; তা একান্তই সরকারের। অর্থাত্ ওই জমি বিজিএমইএ জবরদখল করে আছে। যেকোনো জবরদখলকারীর মতোই বিজিএমইএকে উচ্ছেদ করতে এবং ভবন ভেঙে দিতে সরকার বাধ্য। ভবনের যে অংশ ব্যাংকসহ কয়েকজন ব্যক্তিমালিকের কাছে বিজিএমইএ বিক্রি করেছে, তাদের টাকা ফেরত দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে। এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, দাবি করার ১২ মাসের মধ্যে বিক্রীত অর্থ ফেরত দিতে হবে। কারণ বিজিএমইএ ভবনের সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল বেআইনি। তাই ওই ভবন নির্মাণ বা ভবনের অংশ কারো কাছে বিক্রি করার কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। এছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের পেছনে আদৌ কোনো জনস্বার্থ নেই। ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে একান্তই বিজিএমইএর সদস্যদের নিজস্ব স্বার্থের খাতিরে।

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৩ সালের ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে। চলতি বছরের ২ জুন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বিজিএমইএর লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে অনতিবিলম্বে নিজ খরচে বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। বিজিএমইএ তাতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবনটি ভেঙে ফেলতে বলেন আপিল বিভাগ। ভবন ভাঙার খরচও বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়েছে।