Home Bangla Recent উচ্চমূল্যের গার্মেন্টস তৈরিতে ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা

উচ্চমূল্যের গার্মেন্টস তৈরিতে ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা

govt plans to inspect non-apparel factories

বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ব্র্যান্ড মার্কস এন্ড স্পেন্সারের কাছে সম্প্রতি ব্লেজার ও মহিলাদের ড্রেসের উচ্চমূল্যের পোশাকের একটি বড় চালান রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। রপ্তানিকারক ঢাকা ইপিজেডে অবস্থিত এফসিআই বিডি লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্টস। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের ডেনিম এক্সপার্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানও ইউরোপের বাজারে ডেনিম প্যান্টের একটি বড় চালান রপ্তানি করেছে সমপ্রতি। যার এক একটি প্যান্ট সর্বোচ্চ ২৫০ ইউরোতেও বিক্রি হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় দর প্রায় ২১ হাজার টাকা। কেবল এ দুটি প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের বেশকিছু গার্মেন্টস কারখানা এখন উচ্চ মূল্যের পোশাক তৈরি করছে। বিশ্বের নামকরা বহু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের উচ্চ মূল্যের পোশাক নিচ্ছে।

কিন্তু এক দশক আগে এমন বাস্তবতা ছিল না। প্রায় চার দশক আগে শুরু হওয়া গার্মেন্টসের পুরোটা সময় গেছে সাধারণ মানের পোশাক তৈরি করে। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। গত তিন চার বছর আগে উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশ। এর পর থেকে এ ধরনের পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। বেশকিছু গার্মেন্টস কারখানা এ লক্ষ্যে উচ্চ মানসম্পন্ন কাপড় আমদানির পাশাপাশি বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছে। নিয়োগ দিয়েছে দক্ষ জনবল। গুণগত মানসম্পন্ন ও ফ্যাশন দুরস্ত পোশাক তৈরিতে গবেষণা ও উন্নয়নেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান আলাদা ইনোভেশন সেন্টার তৈরি করেছে। চেষ্টা চলছে নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠারও। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড প্রবেশ করেছে ইউরোপের বাজারে!

মার্কস এন্ড স্পেন্সারের ঢাকা অফিস জানিয়েছে, গত বছর তারা বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পোশাক আমদানি করেছে, তার ২০ শতাংশ ছিল উচ্চমূল্যের। মার্কস এন্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশ অফিসের প্রধান স্বপ্না ভৌমিক ইত্তেফাককে বলেন, গত দুই তিন বছর থেকে তারা বাংলাদেশ থেকে উচ্চমূল্যের গার্মেন্টস আমদানি করছেন। কিন্তু শুরু করাটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মনোভাব পরিবর্তন করাটা অত সহজ ছিল না। যতবার তাদের বলেছি, বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করতে পারে, ততবারই প্রশ্নের মুখে পড়েছি। কিন্তু এখন ভালো সাড়া পাচ্ছি। এখন এই ব্র্যান্ডের উচ্চদরের পোশাকের ভালো অংশের জোগান দেয় বাংলাদেশের কয়েকটি গার্মেন্টস।

মার্কস এন্ড স্পেন্সার ছাড়াও কেলভিন ক্লেইন, টমি হিলফিগার, হুগো বস, মাইকেল কর, অলিম্প, র্যাল্ফ লরেন্স, নেক্সট, টার্গেট, গ্যাপ, আমেরিকান ইগল, আমস্টারডাম ডেনিম, পেট্রোল, ওল্ড নেভি, গ্যাপ, ব্যানানা রিপাবলিকসহ বেশকিছু ব্র্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ এখন উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি করে।

গার্মেন্টস উদ্যোক্তা ও আমদানিকারক ব্র্যান্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ব্লেজার ছাড়াও মহিলাদের অফিসিয়াল ড্রেস, পার্টি ড্রেস, সোয়েটার, ডেনিম প্যান্ট, স্যুট, জ্যাকেট, অন্তর্বাস, অ্যাকটিভ অয়্যার (ইয়োগার জন্য ব্যবহার হয়), স্পোর্টসওয়্যার বাংলাদেশে তৈরি হয়। এমনকি বিয়ের পোশাক কিংবা পর্বতারোহীদের জ্যাকেটও তৈরি হয় এখানে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত ডেনিম এক্সপার্ট নামে একটি গার্মেন্টস ইউরোপের একাধিক ব্র্যান্ডের কাছে উচ্চমূল্যের ডেনিম প্যান্ট রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন ইত্তেফাককে জানান, তার রপ্তানি করা ডেনিম প্যান্টের ৭৫ শতাংশই উচ্চমূল্যের। বেশিরভাগেরই খুচরা মূল্য একশ’ ইউরোর উপরে। সর্বোচ্চ ২৫০ ইউরো দামের প্যান্টও তৈরি হয় তার কারখানায়। মোস্তাফিজ উদ্দিন ‘ব্লুএক্সঅনলি’ নামে একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন। গত দুই বছর ধরে ওই ব্র্যান্ডের পোশাক ইউরোপের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে।

কত ডলারের খুচরা বিক্রয়মূল্যের পোশাক উচ্চমূল্যের হিসেবে বিবেচিত হবে-তার কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। তবে ৬০ ডলারের উপরে বিক্রি হলে সেটিকে উচ্চমূল্যের পোশাক হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।  বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের প্রায় ৪০ শতাংশ উচ্চমূল্যের পোশাক। বাংলাদেশ গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। রপ্তানি পণ্যের কত শতাংশ উচ্চমূল্যের, তেমন তথ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বা অন্য কারো নেই। তবে বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন, মোট রপ্তানির প্রায় ১০ শতাংশ উচ্চমূল্যের পোশাক।

বিশ্বব্যাপী উচ্চমূল্যের পোশাকের বেশিরভাগেরই জোগান দেয় চীন। এর বাইরে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, মেক্সিকো, ইতালিসহ ইউরোপের কিছু দেশেও উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাক উত্পাদন হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশে উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করে-এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে শান্তা অ্যাপারেল, মেঘনা নিট, এনার্জিপ্যাক, ইউনিভার্সাল, ভিয়েলাটেক্স, ইন্টারফ্যাম, ইপিলিয়ন, এসকিউ সোয়েটার, এসকিউ বিরিকিনা, টেক্সওয়েভ, নিউ এজ, গ্রামীণ নিটওয়্যার, টিআরজেড। সম্প্রতি বেশকিছু উদ্যোক্তা উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে ঝুঁকেছেন।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, উচ্চমূল্যের পোশাকের জন্য মানসম্পন্ন কাপড়ের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ওয়াশিং, প্রিন্টিং এবং ফিনিশিংয়ে মুন্সিয়ানার পাশাপাশি দামি ও অত্যাধুনিক এক্সেসরিজ এবং ডিজাইনের বিশেষত্ব। কোন জায়গার কাপড় বা সুতা ব্যবহার হচ্ছে, সেটিও গুরুত্ব বহন করে। সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন সচেতন ক্রেতার চাহিদা ও হাল আমলের কিংবা নিকট ভবিষ্যতের ফ্যাশনের গতিধারা বুঝতে হয়। নতুন ও সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা পোশাকের ডিজাইনে প্রতিফলিত হতে হবে। এ জন্য বিশ্বব্যাপী এ ধরনের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র (রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন সেন্টার) আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করা একাধিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় এসকিউ গ্রুপের কারখানায় এ ধরনের একটি ইনোভেশন সেন্টার রয়েছে। এ সেন্টারটি ক্রেতার চাহিদা এবং হাল আমলের ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে কাজ করে। আগামী এক দুই বছর পরে কী ধরনের ফ্যাশন চালু হতে পারে-এ সব বিষয় নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করে।

উদ্যোক্তারা উচ্চমূল্যের পোশাকের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের পোশাকের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস প্রয়োজন। অন্যদিকে সাধারণ মানের পোশাক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এ ধরনের পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মনোভাবের পরিবর্তনও জরুরি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্র্যান্ডগুলোর মনোভাবের পরিবর্তনও প্রয়োজন। এ ধরনের পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন:

মোস্তাফিজ উদ্দিন, এম ডি, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

প্রতিনিয়ত ফ্যাশন পরিবর্তন হচ্ছে। নিত্য-নতুন ডিজাইন আর ফ্যাশনের পণ্য বাজারে আসছে। ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদায়ও পরিবর্তন আসছে। এক সময় বিদেশি ক্রেতারা (বায়ার) তাদের নির্দিষ্ট ডিজাইন অনুযায়ী পোশাক বানানোর অর্ডার দিত। কিন্তু আমার কাছে যদি বৈচিত্র্যসম্পন্ন ফ্যাশন আর নতুন ডিজাইন থাকে-সেটি ক্রেতার পছন্দ হলে, দরাদরিতে আমার অবস্থান শক্ত হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি পণ্যের ৭৫ শতাংশই উচ্চমূল্যের।

সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বিজিএমইএ

উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সাধারণ মানের পোশাক তৈরি করে মুনাফা খুবই কম থাকে। উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে মুনাফা থাকেও না। ভবিষ্যতে উত্পাদন খরচ আরো বাড়বে। অথচ পোশাকের মূল্য বাড়ছে না। অন্যদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দর কমছে। ফলে সাধারণ মানের বা মূল্যের পোশাক তৈরি করে টিকে থাকা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের পোশাকে মুনাফার পরিমাণ তুলনামূলক কিছুটা বেশি থাকায় তারা বাড়তি সুবিধা পাবেন। ব্যবসায়ে টিকে থাকতে পারবেন।

আহসান এইচ মনসুর, অর্থনীতিবিদ

দেশের উদ্যোক্তারা গত কয়েক দশকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তাতে উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। বাংলাদেশ সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে। কেননা চীন ধীরে ধীরে এ খাত থেকে সরে আসছে। ফলে ওই বাজার ধরার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। তবে এ জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল, কারিগরী জ্ঞান ও উদ্যোক্তাদের বাড়তি বিনিয়োগের আগ্রহ থাকতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here