Home Bangla Recent কাঁচা চামড়া সংগ্রহে অনিশ্চয়তা

কাঁচা চামড়া সংগ্রহে অনিশ্চয়তা

কোরবানির ঈদে এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা

সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরিত সব ট্যানারি এখনো চালু হয়নি। কাঁচা চামড়া কিনতে গত ঈদুল আজহায় দেওয়া ব্যাংকঋণের অর্ধেকও পরিশোধ করেনি অনেক ট্যানারির মালিক। এতে কাঁচা চামড়া কিনতে এবার ঋণের কতটা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এর সঙ্গে চামড়া পাচারের আশঙ্কাও আছে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদুল আজহায় এ দেশের ট্যানারিগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অন্যদিকে সাভার চামড়া শিল্প নগরীর ডাম্পিং ইয়ার্ড ভরে গিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। এতে ট্যানারিতে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। ট্যানারির মালিকদের অভিযোগ, এতে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এতে গতবারের সংগৃত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে গেলেও অনেক ট্যানারিতে এখনো পড়ে আছে। এতে নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থানের সংকট আছে।

তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আসন্ন ঈদের আগেই চলমান সমস্যার বেশির ভাগই সমাধান হবে। ট্যানারির মালিকরা নিজেদের দায় এড়িয়ে সরকারের আশ্বাস মানতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, সাভার শিল্প নগরীর চলমান সমস্যা এবং আর্থিক সংকটে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এ দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি খাতের বিরাজমান সমস্যার কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং ট্যানারির মালিকরা উভয়ই তাদের দায় এড়াতে পারে না। আসন্ন কোরবানির ঈদে এসব সমস্যার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ সম্ভব হবে না বলে মনে করছি।’ তিনি বলেন, সিইটিপি এখানো সম্পূর্ণ চালু না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। অনেক ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যায়নি। অন্যদিকে কাঁচা চামড়া কিনতে সরকারের দেওয়া ব্যাংকঋণ ট্যানারির মালিকরা বিভিন্ন অজুহাতে পরিশোধ না করায় এ ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারা বছরে দেশে প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর অর্ধেকই জবাই হয় কোরবানির ঈদের সময়। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে দেশে এখন এক কোটি ১৬ লাখ ‘কোরবানিযোগ্য’ গবাদি পশু আছে। এর মধ্যে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু ও মহিষ এবং ৭১ লাখ ছাগল ও ভেড়া।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে ১৫৫টি ট্যানারি রয়েছে। এর মধ্যে ১১০টি ওয়েট ব্লু এবং ২০টি ক্রাস্ট উৎপাদন করছে। বাকিগুলো উৎপাদনে যেতে পারেনি।

বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাভারে নতুন কারখানা নির্মাণে বাড়তি বিনিয়োগ করছে অনেক ট্যানারির মালিক। বড় মাপের দু-চারটি ট্যানারির সমস্যা না হলেও মাঝারি ও ছোট মাপের ট্যানারিগুলো পুঁজি সংকটে বিপাকে পড়েছে। অন্যদিকে সাভার শিল্প নগরীর ডাম্পিং ইয়ার্ড ভরে গেছে। এতে চামড়া কাটার পর ময়লা কোথায় ফেলবে, তা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সিইটিপিও সম্পূর্ণ চালু হয়নি। এতে ট্যানারিতে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এতে অর্ডার কম আসছে। সরকার থেকে বার বার আশ্বাস দিলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, চামড়াজাত পণ্য বিক্রিতে নেতিবাচক ধারা রয়েছে। গত কোরবানির ঈদের পর যাও বা অর্ডার পাওয়া যায় সে অনুযায়ী পণ্য দিতে হিমশিম খাচ্ছে ট্যানারির মালিকরা। উৎপাদন কমে গেছে। সর্বশেষ হিসাবে চামড়া খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৭-২৮ শতাংশ কমে গেছে। এতে গত এক বছরে ট্যানারিতে সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া পড়ে আছে। এতে নতুন কাঁচা চামড়া কিনে কোথায় রাখবে? ব্যবসা ভালো না থাকায় অনেক ট্যানারি গতবার চামড়া কিনতে পাওয়া ঋণের অর্ধেকও শোধ করতে পারেনি। চামড়া কিনতে গতবারের সমান অর্থও পাবে কি না, তাতে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর সঙ্গে পুরনো ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে কাঁচামাল সংগ্রহের এ মৌসুমেও আর্থিক সংকটে পড়েছে এ দেশের বেশির ভাগ ট্যানারির মালিক।

ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, ‘অতীতে কোরবানির ঈদের সময় ভারতের অনেক ট্যানারি বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে কাঁচা চামড়া কিনে নিয়ে যায়। চামড়া পাচার বন্ধে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন।’

চামড়া খাতের বিভিন্ন সংগঠন সূত্র জানায়, এ দেশের গুণগতমানের কাঁচা চামড়ার বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে। ভারতের বামতলা, কানপুর, চেন্নাই, পাঞ্জাবে কয়েক হাজার ট্যানারি আছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর গরু জবাইয়ে কঠোরতা আরোপ করা হয়। গরুনীতিতে কঠোরতা আরোপের পর ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার সংকট তৈরি হতে থাকে। এ দেশে কোরবানির ঈদে অধিক পরিমাণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সুযোগ থাকে। ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের সুবিধা পায়। ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীদের চাহিদা কাজে লাগিয়ে এ দেশ থেকে চামড়া পাচার হয়ে যায়।

এপেক্স ফুটওয়্যার ও এপেক্স ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরে বড় ধরনের বিনিয়োগের ধাক্কায় পড়েছে অনেক ট্যানারি। এর ধাক্কা কটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে চামড়া পাচার হয়ে গেলে কাঁচামালের সংকটে চামড়া ব্যবসায়ে বিপর্যয় নেমে আসবে। সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।’

ঈদুল আজহার দিনে স্থায়ী এবং মৌসুমি দুই ধরনের ব্যবসায়ীরাই পাড়া-মহল্লা ঘুরে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে মজুদ করে। এরপর তা কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে থাকে। আড়তদাররা বেশি পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তা ট্যানারির মালিকদের কাছে বিক্রি করে। অনেক সময় কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীরা আড়তদারদের কাছে না দিয়ে সরাসরি ট্যানারির মালিকদের দিয়ে থাকে।

সাধারণত ঈদুল আজহার দিন পনের আগে থাকতে বেশির ভাগ ট্যানারি কাঁচা চামড়া সরবরাহকারীদের সঙ্গে কী পরিমাণ চামড়া সরবরাহ করবে, কাঁচা চামড়ার সম্ভাব্য দর ধরে মোট মূল্যের ৩ ভাগের ১ ভাগ বা ৪ ভাগের ১ ভাগ অগ্রিম অর্থ (দাদন) দিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে চুক্তি সেরে ফেলে। প্রতিবছরই কাঁচা চামড়া কিনতে ঈদুল আজহার আগে ট্যানারির মালিকদের গড়ে ৪০০-৫০০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ দেওয়া হয়। এ ঋণের ওপর নির্ভর করে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে নামে বেশির ভাগ ট্যানারি। তবে শর্ত থাকে ঋণের অর্থ পরের বছর ঈদুল আজহার আগেই পরিশোধ করতে হবে। গতবার কাঁচা চামড়া কিনতে সরবরাহ করা ব্যাংকঋণের অর্ধেকও পরিশোধে করেনি বেশির ভাগ ট্যানারি। তাই চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকঋণ পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

শিল্পসচিব মো. আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামীকাল (আজ সোমবার) ট্যানারির মালিকদের সঙ্গে সাভার শিল্প নগরীসহ চামড়া খাতের সমস্যা নিয়ে বৈঠক করব। আশা করি, ঈদের আগেই এসবের অনেকটা সমাধান হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here