Home Apparel বাড়তি ব্যয়ে অস্থির পোশাক খাত

বাড়তি ব্যয়ে অস্থির পোশাক খাত

পোশাক শিল্পে গত কয়েক বছরে ব্যয় বেড়েছে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল। বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স, পৌরকর এবং বন্দর খরচ; অন্য দিকে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছ ৫১ শতাংশ। কিন্তু পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি, উল্টো কমেছে।

অন্য দিকে কমেছে রফতানিরও। অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রফতানিমূল্যও প্রতিনিয়ত কমছে। এসব কারণে রফতানিবাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১৩০০ কারখানা। বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাই ও অসন্তোষ। স্বল্পসংখ্যক বড় কারখানার কথা বাদ দিলে বেশির ভাগ কারখানার জন্য কোনো সুসংবাদ নেই আগামী দিনের রফতানি আদেশেও।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) বিগত তিন মাসের রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে তৈরী পোশাকের নিট ও ওভেন উভয় খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি কোনোটাই অর্জিত হয়নি। পোশাক খাতে রফতানি আয় হয়েছে ৮০৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এ ছাড়া প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১০ কোটি ৬৭ লাখ ডলার।

গত আগস্ট মাসে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৬৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সময় আয় হয়েছে ৬৭৩ কোটি ২১ লাখ ডলার। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের এ সময় আয় হয়েছিল ৬৭৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। একই সাথে ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরী পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ০.৩৩ শতাংশ। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, আয় হয়েছে ৫৭১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ কম।

এ সময় নিট পোশাক রফতানিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩১৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। আর আয় হয়েছে ২৯২ কোটি ডলার। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ কম। ওভেন পোশাকে আয় হয়েছে ২৮৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪.৪৬ শতাংশ কম। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩২৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার।

রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরী পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলোতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলেও বাংলাদেশে স্থিতিশীল রয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে পোশাক রফতানি ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকায় প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুযায়ী, গত দুই দশকে দেশে তৈরী পোশাকের উৎপাদন ও রফতানি তিন গুণ বাড়লেও বাড়েনি শ্রমিকের কর্মসংস্থান। উল্টো নতুন নতুন কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর কাজ হারাচ্ছে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। বিপরীতে কর্মসংস্থান হচ্ছে এক লাখের মতো। শ্রমিকের স্থান দখল করে নিচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি। মানুষের পরিবর্তে রোবট ব্যবহারের উদ্যোগও নিচ্ছেন কোনো কোনো মালিক। চাকরি হারানো শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী।

আর নতুন করে যাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই পুরুষ ও প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন। স্বাভাবিক কারণেই নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৯০ শতাংশ থেকে কমে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর মোট শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ লাখে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ওপর একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পরিচালিত জরিপে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। আগামী এক দশকে এ খাতের জনবল অর্ধেকে নেমে আসবে বলে অনুমান সংশ্লিষ্টদের।

আয়-ব্যয়ের হিসাবে গরমিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মজুরি বেড়েছে ৫১ শতাংশ। মনে করেন, একটি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের মাসিক বেতন আসে এক কোটি টাকা। নতুন কাঠামো অনুযায়ী ওই মালিককে এখন বেতন দিতে হবে এক কোটি ৫১ লাখ টাকা। তাহলে কি ওই ফ্যাক্টরি বিগত দিনে মাসে ৫১ লাখ টাকা হারে লাভ করেছে? অসম্ভব! তাহলে এই বাড়তি টাকাটা আসবে কোত্থেকে? জায়গা একটাই, বায়ারদের কাছ থেকে ফিনিশড পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিতে হবে। অথবা অন্য খরচ কমাতে হবে। যদিও এটা অনেক কঠিন। কারণ এ দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সবকিছুরই বিল দিনে দিনে বাড়ছে।

বায়াররা দাম না বাড়ানোর কারণে এক সিজন অর্ডার ফিরিয়ে দেয়ায় তার কোম্পানির রফতানি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে জানিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কিন্তু খরচ তো আর কমেনি, মাস শেষে শ্রমিকের বেতনসহ ফ্যাক্টরির যাবতীয় খরচ, ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ, কোনো কিছুই কিন্তু থেমে থাকেনি। গত এক বছরেও সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

পণ্যের দাম চাইলেই বাড়ানো যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি রিফিউজ করলে কী হবে? অর্ডার তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করেনি, হয় আমার দেশেরই অন্য কোনো ফ্যাক্টরি নিয়েছে অথবা অন্য কোনো দেশে চলে গেছে।

কম দামে অর্ডার নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, অর্ডার না নিয়ে গত ৬ মাসে ৬ কোটি টাকা লসসহ গত এক বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার একটা বড় ঘাটতিতে পড়েছি। কম দামে যারা অর্ডার নিচ্ছে তারা অর্ডার নিয়ে হয়তো লস করেছে ২৫ লাখ, না নিলে লস হতো এক কোটি টাকা। বিষয়টি যদি এরকম হতো যে অর্ডার না নিয়ে ফ্যাক্টরি ৩ মাস ৬ মাস বন্ধ রাখলে কোনো খরচ নেই, তাহলে অর্ডার না নেয়ার মতো আপনার সহজ পরামর্শটা সানন্দে গ্রহণ করা যেত।

মোহাম্মদ হাতেমকে প্রশ্ন করা হয়, কম দামি পণ্য না বানিয়ে চীনাদের মতো দামি পোশাকের অর্ডার নেন না কেন? জবাবে তিনি বলেন, যে দেশের শ্রমিকের উৎপাদনদক্ষতা ৪০ শতাংশ সে শ্রমিক দিয়ে কম দামি পণ্য ছেড়ে বেশি দামি পণ্য বানানোর মতো অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে হ্যাঁ, বাঁচতে হলে আমাদেরও শ্রমিকের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং দামি পোশাক বানানোর কাজ নিতে হবে। অন্যথায় বাড়তি মজুরি পরিশোধ করতে গিয়ে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সাথে কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, মাইন্ডসেট করাতে হবে, যেহেতু বেতন বেড়েছে, উৎপাদনও বাড়াতে হবে, অন্যথায় টিকে থাকা অসম্ভব।

অনৈতিক প্রতিযোগিতার কথা উঠে এসেছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কণ্ঠেও। বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক রফতানি কমে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরাই দায়ী। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের একটা সমস্যা আছে। তারা নিজেরা আন্ডারকাট করে দাম এমন অবস্থায় নিচ্ছে, যাতে কেউ দাম পাচ্ছে না। মোট রফতানি মূল্যের ওপর সেটার প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, আমি নিজেও একজন ব্যবসায়ী, তাই জানি এ ধরনের একটি সমস্যা রয়েছে। কারণ অনেক সময় দেখা যায় কাজ পাওয়ার জন্য তারা দাম কমিয়ে দিচ্ছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় আমাদের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। বায়ারদের মতে আমরা দামের কারণে প্রতিযোগিতায় যেতে পারছি না। সেটার জন্য সবদিকেই চেষ্টা করতে হবে। ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে যে সাহায্য চেয়েছে সেগুলো ছাড় দিলে আমাদের প্রতিযোগিতা বাড়বে বলে আশা করি।

তবে তার চেয়েও বড় কথা আমাদের প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য কিছু সুবিধা দরকার। ক্লিয়ারেন্স পেতে যদি ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যায়, বায়ার যদি দেখে শিডিউল টাইমের চেয়ে ২০-২৫ দিন বেশি লাগে তাহলে দামে ছাড়ের প্রশ্ন আসে না। এসব কারণে অনেক ফ্যাক্টরিকে বিমানে মাল পাঠাতে হয়। একবারে মাল পাঠাতে সে বছরের সব প্রফিট চলে যাবে। সময়ের ব্যাপারটি সরকার বিবেচনায় নেবে বলে আশা রাখি।

ফ্যাক্টরিগুলোর কাছে আবেদন, আমরা নিজেরা আন্ডারকাট না করে আমাদের ব্র্যান্ড ভালো করা দরকার। বাজারে গ্লোবাল পরিচিতি বাড়ানো দরকার। কোয়ালিটির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আশাবাদী যে সামনের দিনগুলোতে হয়তো উন্নতি করব। কিন্তু কবে নাগাদ করব তা বলা মুশকিল।

এরই মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি। কোনোরূপ পূর্বাপর বিবেচনা ছাড়াই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের প্রতিটি পোশাক কারখানাই ওয়াশিং ও ফিনিশিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আর ওয়াশিং কারখানাগুলোতে বয়লারের ব্যবহার হয়।

আমরা মনে করি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবনা শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কেননা বস্ত্র ও তৈরী পোশাক খাতের সমান্তরাল প্রবৃদ্ধির সাথে এ দু’টি খাতেরই সমৃদ্ধি ও বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তিনি বলেন, কিছুদিন পরপর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। সরকারের কাছে আমাদের একান্ত অনুরোধ, শিল্পকে সহায়তা করার জন্য অনতিবিলম্বে একটি জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করুন এবং এই নীতির মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিন। এমন কোনো পদক্ষেপ নিবেন না, যাতে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হয়, শ্রমিক কর্মসংস্থান হারায়, সর্বোপরি অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here