Home বাংলা নিউজ বস্ত্র খাতের বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন

বস্ত্র খাতের বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বস্ত্র খাতের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে তৈরি পোশাক খাত। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘বস্ত্র’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের বস্ত্রের চাহিদা-জোগানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। ফলে এ তৈরি পোশাকশিল্প খাতের মাধ্যমে নারীদের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। দেশের অভ্যন্তরীণ বস্ত্রের চাহিদা পূরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ও বস্ত্রশিক্ষার ক্ষেত্রে চাহিদাভিত্তিক মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল সৃষ্টি লক্ষ্যে ‘বস্ত্র আইন, ২০১৮’ ও ‘বস্ত্রনীতি, ২০১৭’ প্রণীত হয়েছে। তাছাড়া হস্তচালিত তাঁতশিল্পের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও তাঁতিদের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড আইন, ২০১৩’ প্রণীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে তিনগুণ অর্থাৎ ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া এই সময়ে তাঁতশিল্পে উৎপাদিত বস্ত্র সামগ্রী বিদেশে রপ্তানির পরিমাণও অনেক বেড়েছে। বস্ত্র অধিদপ্তর পোষক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বস্ত্র খাতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ৬৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন টাকা। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্প খাতকে আরও শক্তিশালী, নিরাপদ ও প্রতিযোগিতাসক্ষম করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সরকারের এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের ‘পোষক কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে বস্ত্র অধিদপ্তর তথা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ২০২১ সাল নাগাদ এ খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্য অর্জনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বস্ত্রশিল্প-সংশ্লিষ্ট সব অংশীজন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিজিবিএ ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পসংশ্লিষ্ট সংগঠন/সমিতিকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নিবন্ধিত বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের মাধ্যমে কমপ্লায়েন্স পর্যবেক্ষণ ও নিশ্চিতকরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বস্ত্রশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বস্ত্র খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে বস্ত্র অধিদপ্তর কাজ করছে। এ অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে সাতটি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সাতটি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ৪২টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের ছয় হাজার ৩৬০টি আসন ও কারিগরি শিক্ষায় সাতটি প্রতিষ্ঠানে ৮৪০টি আসনে শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ রয়েছে এবং ভর্তি, আবাসনসহ সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর বিএসসি, ডিপ্লোমা এবং এসএসসি ভোকেশনাল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কর্তৃক নরসিংদী, সিলেট ও পাবনা জেলায় তাঁতিদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠান শিগগিরই চালু হবে। এসব প্রতিষ্ঠান স্বল্প খরচে বস্ত্র খাতের জন্য দক্ষ শ্রমিক, সুপারভাইজার, ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ সর্বোপরি স্নাতক পর্যায়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি বস্ত্রশিল্প কারখানায় সরবরাহ করছে। করোনাকালে দেশবাসীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে খোঁজ-খবর রাখছেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিনি প্রতিটি বিষয় প্রতি মুহূর্তে মনিটর করছেন। করোনা মহামারি থেকে মানুষের জীবনকে বাঁচাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে, দরিদ্র মানুষকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানসহ শিল্প খাতে শ্রমিকদের বেতনের জন্য বিশেষ তহবিলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাদুকাশিল্পে দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তনে এক হাজার ১৩২ কোটি টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ৯ লাখ তাঁতি ও এক হাজার তিনশ’রও বেশি তাঁতি সমিতি রয়েছে। তাঁতিদের সংগঠিত করে তাঁতি সমিতি গঠন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পেশাগত দক্ষতাবৃদ্ধি ও বস্ত্রের মানোন্নয়নে সরকার ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড দেশের প্রান্তিক তাঁতিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, চলতি মূলধন জোগান, গুণগত মানসম্পন্ন তাঁতবস্ত্র উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁতিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। তাঁতশিল্পের উন্নয়নের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সাতটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাঁতিদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং হস্তচালিত তাঁতে কাপড় উৎপাদন এবং উন্নত প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের জন্য সিলেট, রংপুর ও নরসিংদীতে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বেসিক সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। বাজারের চাহিদা এবং ভোক্তার পছন্দ অনুযায়ী নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত নতুন ডিজাইনের ওপর তাঁতিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাঁত বস্ত্রের উন্নয়নে ফ্যাশন ডিজাইন ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধারের কাজ চলমান রয়েছে। বিটিএমসির বন্ধ হওয়া মিলগুলোর মধ্যে ১৬টি মিল পিপিপি’র মাধ্যমে চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এরই মধ্যে দুটি মিলের আধুনিকায়ন ও উৎপাদন শুরু করার জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) চালু করা হয়েছে। বিটিএমসি’র বাকি বন্ধ মিলগুলো চালু করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া দেশের রেশমশিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। সম্ভাবনাময় বস্ত্রশিল্পের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও বিকাশের লক্ষ্যে বস্ত্র খাতে দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে ২০৩০ সালের এসডিজির নির্ধারিত গোলগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দেশের বস্ত্রশিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব দূরীকরণ এবং স্থানীয় বাজারে বস্ত্রের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে বস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার ঘোষিত উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণ করা সম্ভব হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here