Home বাংলা নিউজ তুলার চড়া দাম, চাপের মুখে পোশাক খাত

তুলার চড়া দাম, চাপের মুখে পোশাক খাত

পোশাকের প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে পণ্যটির রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, অন্যদিকে স্থানীয় তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনেরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে নতুন করে চাপে পড়েছেন স্থানীয় পোশাক উদ্যোক্তারা।

টেক্সটাইল খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুলার দাম বৃদ্ধির কারণে একদিকে কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, ফ্রেইট খরচ বৃদ্ধির সাথে চালান পাঠাতে দেরি হওয়ায় টিকে থাকার জন্য রপ্তানিকারকরা মূল্য নিয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

টেক্সটাইল খাত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, আগামী বছর তুলার উৎপাদন কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে খুব শীঘ্রই কাঁচামালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বরং তা আরও বাড়তে পারে।

রাজধানীর ইসলামপুর এবং কেরানীগঞ্জ থেকে কাপড় কিনে মিরপুর-১ এর শাহ আলী কলেজ মার্কেটে নিজের ছোট কারখানায় ডেনিম প্যান্ট তৈরি করে পাইকারি হিসেবে বিক্রি করেন সুমন দাশ।

আলাপকালে তিনি বলেন, এক বছর আগে যে কাপড় প্রতি গজ ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় কিনতেন, সেই একই কাপড় এখন তাকে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।

“গত সেপ্টেম্বর থেকে দাম বেড়েছে বেশি। কিন্তু, তৈরি পোশাকের দাম বাড়াতে পারিনি। আগের মতই প্রতি পিছ ৩১০ টাকা থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে,” বলেন তিনি।

বস্ত্রের এই ছোট ব্যবসায়ী আরও বলেন “মূলত, করোনা মহামারির কারণে ক্রেতার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় চাহিদা কম। ফলে, বাড়তি দাম নেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের কাছ থেকে কিনে যারা বিক্রি করে, তাদেরও হয়তো একই অবস্থা। নইলে তো আমরা কিছুটা হলেও বাড়তি দাম পেতাম।”

সুমন দাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আসছে ঈদসহ চারটা ঈদই মাঠে মারা গেল। শ্রমিকের বেতন দেব, দোকান ভাড়া দেব নাকি নিজের ঘর ভাড়া দেব?”

দেশের তৈরি পোশাক ও কাপড়ের বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর ইসলামপুর ও কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও পোশাকের প্রধান কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, চাহিদা কম থাকায় তারা দাম বাড়াতে পারছেন না। ‘মূল্য নিয়ে চাপ’ তাদের ঘাড়েই নিতে হচ্ছে।

দেশব্যাপী স্থানীয় বাজারের জন্য পোশাক তৈরি করা উদ্যোক্তাদের অবস্থা অনেকটা সুমন দাশের মতই।

কেবল ছোট উদ্যোক্তা নন, একই পরিস্থিতির মুখোমুখি ব্র্যান্ডেড পোশাক বিক্রতা প্রতিষ্ঠানও। দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড অঞ্জনসের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনারর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, “গত কয়েক মাসে কিছু কাপড়ের দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে। কিন্তু পোশাকের দাম বাড়াতে পারছি না। ফলে মুনাফা কমে যাবে। কারো কারো লোকসানও গুণতে হবে।”

ছোট বড় ফ্যাশন হাউজ, ডিজাইনসহ এই সাপ্লাই চেইনে দেশব্যাপী পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি অর্ধেকের বেশি কমেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আড়ংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার আশরাফুল আলম জানান, কাঁচামালের বাড়তি দাম হিসাব করেই তারা পণ্য মূল্য তৈরি করেন। তবে, তাদের উদ্বেগ তৈরি করেছে নতুন করে সরকার ঘোষিত লকডাউন। এর ফলে কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক বাজার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কার কথা জানান তিনি।

টেক্সটাইল মিল মালিক ও খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত এক বছরের ব্যবধানে তুলার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে স্বাভাবিকভাবে সুতা ও কাপড়ের দাম বেড়েছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (​বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, “গত বছর মহামারির আগে ‍প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিলো ৫৮ থেকে ৬০ সেন্ট। সেই তুলার দাম এখন ১.২ ডলার। অর্থাৎ, তুলার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। অথচ, গত বছর মহামারির সময় প্রতি পাউন্ড সুতার মূল্য ২.৬০ ডলার থেকে ২.৭০ ডলার থাকলেও বর্তমানে সেই সুতার দাম সর্বোচ্চ ৪.১০ ডলার। অর্থাৎ সুতার দাম কিন্তু শতভাগ বাড়েনি। তাহলে, তা ৫ ডলার হওয়ার কথা ছিলো।”

তিনি বলেন, যে হারে তুলার দাম বেড়েছে সে হারে স্থানীয় টেক্সটাইল মিল মালিকরা সুতার দাম বাড়াতে পারেন নি।


মহামারির কারণে তুলার তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই তুলার চাহিদা বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলার উৎপাদন বাড়ছে না। গতবার করোনার কারণে তুলার ফলন ঠিকমতো করা যায়নি। এবারের পূর্বাভাস অনুযায়ীও উৎপাদন কম হওয়ার ধারণা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মো. আলাউদ্দীন মালিক বলেন, “কাঁচামালের দাম বাড়ছে। তবে, কাঁচামালের দাম বাড়লেও চাহিদা কম থাকায় পোশাকের দাম বাড়াতে পারছেন না পোশাক কারখানার মালিকরা। নতুন করে লকডাউন শুরু হওয়ায় কোরবানির বিক্রিও অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।”

সংগঠনটির সদস্য কারখানার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এসব কারখানা মূলত স্থানীয় বাজারের জন্য পোশাক তৈরি করে। গত বছর দেশের করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের বিক্রি প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানান তিনি।

বিটিএমএ’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে পোশাক ও বস্ত্রখাতের বাজার ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থাৎ, প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বস্ত্র খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে ইয়ার্ন, ফেব্রিক, ডায়িং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিংসহ সংগঠনটির সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। তবে এর বাইরেও ছোটবড় মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক কারখানা রয়েছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান বিটিএমএ’র কাছে নেই।

টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তুলার দাম বাড়ার পাশাপাশি কন্টেইনার চার্জ, ক্যারিয়ার কস্ট, পোর্ট চার্জ বেড়ে যাওয়া এবং সুতার কোয়ালিটি ও মেশিনারির কারণেও দামে তারতম্য হয়। এর সঙ্গে চাহিদা ও যোগানের তারতম্য তো রয়েছেই। দেশের তুলা ও সুতার মূল সোর্স ভারত থেকে আমদানি কমে যাওয়ায় স্থানীয় সুতার চাহিদা বেড়েছে। এসব কারণেও রপ্তানিকৃত পোশাকের পাশাপাশি স্থানীয় পোশাকের কাঁচামালের দামে প্রভাব ফেলছে। সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here