Home বাংলা নিউজ দেশীয় বস্ত্রশিল্প বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব

দেশীয় বস্ত্রশিল্প বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব

দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক হলেও সেখানে সেলাই ছাড়া আমাদের বিশেষ কোনো অবদান নেই। অথচ আমাদের অভ্যন্তরীণ দেশীয় বস্ত্রশিল্পকে ঘিরে রয়েছে এক বিশাল বাণিজ্য সম্ভার। বাংলাদেশের তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য। এবারও রমজানের ঈদের সময় লকডাউন থাকায় ঘরে বসে অনলাইনে ঈদ বাজার করার কথা ভাবলাম। সেই অনুযায়ী দেশি যেসব ব্র্যান্ডের পোশাক আমরা কিনে থাকি সেগুলো শুরুতে সার্চ না করে যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন, তাদের পেজে সার্চ দিলাম। কিন্তু যা দেখলাম তা সত্যিই কাক্সিক্ষত ছিল না। অনলাইনের ঘরোয়া বিক্রেতাসহ বড় বড় শপিং মলের বিক্রেতারা (দু একটা ব্র্যান্ডেড দেশি বুটিক হাউজ ছাড়া) পুরো মার্কেট বিদেশি কাপড়ের দখলে।  

নারী, পুরুষ ও ছোটদের পোশাকের প্রায় পুরোটাই ভারত, পাকিস্তান, চীন আর থাইল্যান্ডের দখলে। বিক্রেতারা জানান, ক্রেতাদের বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রতিই আকর্ষণ বেশি। নিত্যনতুন ডিজাইন আর কাপড়ের মান উন্নত হওয়ায় চড়া দাম হলেও এসব পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রেতাদের। যদিও দেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবেই মূলত বিদেশি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। আবার অনেকের রয়েছে দেশীয় পোশাকের প্রতিও সমান চাহিদা। তবে সেই চাহিদার তুলনায় দেশি পোশাকের নতুনত্ব ও বৈচিত্র্যের অভাব আছে। আবার অনেকে উচ্চমূল্যকেও দায়ী করে থাকেন। বিক্রেতাদের মতে, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকার বিদেশি পোশাক আমদানি হয়। এসব পোশাকের দামও ১৫ শত থেকে শুরু করে মানভেদে ১৫ হাজার ১ লাখ, দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। ক্রেতাদের মতে, ‘আকাশ সংস্কৃতির যুগ তো, সবকিছুই হাতের মুঠোয়। দেখা যায়, টিভিতে অ্যারাবিয়ান পোশাক দেখছি আবার কখনো ইন্ডিয়ান দেখছি। হঠাৎ মনে হলো আমি তাদের পোশাক কিনব’।

বড় বড় শপিংমলগুলোতে দেখা যায় দু একটা দেশি ব্র্যান্ডের শো-রুম ছাড়া ক্রেতাদের চাহিদা থাকায় ভারতীয় বিখ্যাত ডিজাইনারের ডিজাইন করা পোশাক আমদানি করে থাকেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। রাজেশ মালহোত্রা, মনীশ মালহোত্রা, সংগীতা শিবরানী ও সত্য পালের মতো ডিজাইনারদের ডিজাইন করা শাড়ি, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা। শেরওয়ানি টাইপ পাঞ্জাবি ও কুর্তা, প্যান্ট-শার্ট। পাশাপাশি দেশি ব্রান্ডের বিভিন্ন দোকানেও ভারতীয় তন্তুজ, ভাগলপুরের সিল্ক, পার্টি শাড়ি, দিল্লি কটন, বোম্বে ডিজাইনের শাড়ি, দিল্লির লেহেঙ্গা, সারারা লেহেঙ্গা বিক্রি হতে দেখা যায়। এ ছাড়া পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের মধ্যে সানা সাফিনা, লাখানি, আসিমজোফা, মারিয়াবি, তাবাক্কুল, প্যাটেল, মতিস, রানাজ, যাওয়াদ এবং ভারতীয় বিবেক, ভিনয়, একতা ও ইত্যাদি থ্রি-পিস ও শাড়িতে বাজার সয়লাব। দেশীয় পোশাক উদ্যোক্তারা বলছেন, অবৈধ পথে পোশাক আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা কঠিন। তবে এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে অর্থপাচারের মতো অপরাধও বাড়ছে।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বা সারা বছর কত টাকার পোশাক আমদানি করা হয় তার সঠিক তথ্য সরকারি কোনো দপ্তরে নেই। কারণ বৈধ-অবৈধ উভয়ভাবে পোশাক আমদানি হয়। এলসি অথবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বৈধভাবে পোশাক আমদানি করা হয়। আবার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবেও পোশাক আমদানি করা হয়। মাঝে মধ্যে বিজিবির অভিযানে এ ধরনের চালান ধরা পড়লেও সেটি একেবারেই নগণ্য। এর সঙ্গে আন্ডার ইনভয়েসিং তো আছেই। তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মতে, শুধুমাত্র ঈদ উপলক্ষে আট হাজার কোটি টাকার বিদেশি পোশাক বৈধ-অবৈধভাবে আমদানি হয়। প্রতি বছর প্রায় ৭-৮ হাজার কোটি টাকার কাপড় আমদানি করা হয়। পোশাকের ওপর শুল্ক কর বেশি আরোপ করায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে বৈধপথে পোশাক আমদানি করেন না। এতে সরকার-ব্যবসায়ী উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ীর ধারণা শুল্ক কর কমানো হলে একদিকে বৈধপথে পোশাক আমদানি বাড়বে, অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ও গতি পাবে। এদিকে বিটিএমএ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের পোশাকের বাজারের ৪০ ভাগ দখল করে আছে বিদেশি কাপড়। এখনই বিদেশি কাপড় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে স্পিনিং মিলসহ শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধায় আনা শুল্কমুক্ত কাপড়-সুতাসহ অন্যান্য পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে মারাত্মকভাবে দেশীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ববাজারের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে স্থানীয় স্পিনিং মিলসহ প্রাইমারি খাতের কারখানাগুলো। বর্তমানে গ্যাস বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে দামের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। আর সেই জায়গা দখল করে ভারত-চীনসহ বিদেশি কাপড়। বন্ডেড সুবিধায় আনা পণ্যের গায়ে ‘নট ফর সেল’ লিখে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।

জানা গেছে, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক উৎপাদনে ব্যবহার করা সুতা কিংবা কাপড় আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই শুল্কমুক্ত এই আমদানির সুবিধা পেয়ে থাকে। এর বাইরে দেশীয় বাজারের জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশে সুতা-কাপড় আমদানিতে গড়ে ৬২ শতাংশ শুল্কারোপ রয়েছে। বন্ড লাইসেন্স অপব্যবহারের মাধ্যমে এই পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজার দখলে নিয়েছে অবৈধ সুতা এবং কাপড়। এতে একদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে দেশীয় বস্ত্রশিল্প। করোনাকালের আগে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহারের কারণে দেশে এক লাখের মতো তাঁতের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ বন্ধ ছিল। রপ্তানিমুখী সুতা এবং কাপড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত মিলগুলোও চোরাইপথে আমদানি করা সুতার কারসাজিতে বিপদে পড়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট মিলগুলো। সাধারণত রোজার ঈদ সামনে রেখে সুতা এবং কাপড় তৈরির মিলগুলো উৎপাদনমুখর থাকে। কিন্তু শুল্কমুক্ত আমদানির অপব্যবহারের কারণে মিলগুলোর কার্যক্রম ক্রমশ স্থবির হয়ে পড়ছে।

আমরা জানি, গ্লোবাল অর্থনীতিকে গ্রহণ করা ছাড়া এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা সম্ভব না। ভারতে আরএসএস বা স্বদেশি জাগরণ বলে একটা প্রোপাগান্ডা সংগঠন আছে। বছরখানেক আগে তারা চীনবিরোধী একটা সেøাগান তুলেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র স্মার্টফোনের ব্যবহারের দিক থেকেই যদি ধরি তবে ভারতে ৯০ ভাগের ওপরে চীনের স্মার্টফোন। স্বদেশি ধরনের অর্থনীতি বাস্তবায়ন আধুনিক দুনিয়ায় খুবই অসম্ভব। তবে যা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে আছে তাকে কেন আমরা গুরুত্ব দেব না? আমাদের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষের রুটি রুজি, স্বপ্ন, আশা। সেখানে আমরা দেশি পণ্য রেখে বিদেশের দিকে কেন ঝুঁকছি? কার্ল মার্কসের ভাষায় টাকা বা মুদ্রার রূপ নিয়ে হাজির পুঁজি নিজেকে কলকারখানা কিংবা অন্য কোনো উৎপাদক রূপে রূপান্তরিত করতে না পারলে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পৌঁছাবার আগেই তরল অবস্থাতেই টাকা উধাও হয়ে গেলে, কোনো বৈষয়িক উৎপাদনমূলক রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না। তাই দেশীয় বস্ত্রশিল্প রক্ষায় সরকার কঠোর না হলে বিদেশি বস্ত্রের বাজারে পরিণত হবে দেশ। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘিœত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here