Home বাংলা নিউজ করোনাকালে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক পঞ্চম ওয়েবিনার

করোনাকালে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক পঞ্চম ওয়েবিনার

করোনাকালে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক ওয়েবিনারের পঞ্চম পর্ব আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সি আর আবরারের সভাপতিত্বে এবং শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী বীথি ঘোষের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, বাসদ বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব মনীষা চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেলস ওয়ার্কার্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারহানা ইয়াসমিন, গবেষক ও লেখক প্রিসিলা রাজ, গবেষক ফিলিপ গাইন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, তাসলিমা আক্তার, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক আমেনা আক্তার প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য রাখেন রেজাউর রহমান লেনিন। মূল বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি শারীরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈরির পাশাপাশি মানুষে মানুষে, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের বিশাল এক জনগোষ্ঠী বিরুদ্ধে অধিকারহীন, মানবিক মর্যাদাবিহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করছে।’

তিনি মূলত করোনাকালে তৈরি পোশাক শিল্প, চা বাগান শিল্প, হোটেল এবং পর্যটন শিল্প, পাদুকা শিল্প এবং পরিবহন সেবা খাতের শ্রমিকদের অধিকার, মানবিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিষয়ে আলোকপাত করেন।

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘প্রতিবছর হিসেব করে দেখা যায় আমাদের জিডিপির একটি বড় অংশ আসে পর্যটন থেকে। কিন্তু করোনায় পর্যটন খাতের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ। পর্যটনের জন্য কোনো মজুরি বোর্ড নেই, এমনকি কাঠামোও নেই। আমরা ১০০০ কোটি টাকার প্রণোদনার কথা বলেছিলাম। এর অর্ধেক বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকার জন্য এবং বাকি অর্ধেক করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু এটি পরবর্তীতে গ্রহণ করা হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটন একটি দর্শনীয় কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে থাকবে। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যাতায়াত ও ঝুঁকি ভাতা দেওয়া প্রয়োজন। যারা রাস্তার পাশে চা বিক্রেতা ছিলেন, যারা জুতা সেলাই করতেন তাদের খোঁজ কি কেউ নিয়েছে? করোনাকালে শ্রমিকরা চিকিৎসা সুবিধা পর্যন্ত পায়নি।’

তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেন এবং এর পাশাপাশি যুক্তি ও শক্তি একত্রিত করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

রামভজন কৈরী বলেন, ‘চা বাগানে করোনা নেই এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে এবং এবারও তাই করেছে। চা খাদ্য দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত বলে চা বাগানের কার্যক্রম চালু রাখার কথা বলা হয়। গত বছর লকডাউনে চা বাগান খোলা থাকার ফলে মালিকরা শ্রমিকদের একটি করে মাস্ক ও সাবান দেয়। কিন্তু এবারের লকডাউনে সেগুলোরও দর্শন মেলেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘চা বাগানের মালিকরা শ্রমিকদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও তাদের করোনা টেস্ট করানোর ব্যাপারে রয়েছে অনাগ্রহ। আরেকটি বড় সমস্যা হলো, চা বাগানে কতজন করোনা আক্রান্ত বা মারা গেছেন সে ব্যাপারে আলাদা কোনো হিসাব রাখা হয় না। এখন পর্যন্ত পাঁচ জনের মৃত্যুর সংবাদ জানি আমরা। কিন্তু উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’

‘চা বাগানেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। মাস্ক, করোনা টেস্ট, স্যানিটাইজারের ব্যাপারে মালিকদের আগ্রহ কম। তাই চা বাগানে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।

কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে রামভজন কৈরী বলেন, ‘শ্রমিকদের ঝুঁকি ভাতা বা প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হলেও আমলে নেয়নি। শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলে তবেই তাদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।’

গবেষক ফিলিপ গাইন বলেন, ‘আমরা আজ যে সংকটের মুখে তার প্রধান কারণ করোনাভাইরাস। স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের ৪০ শতাংশ খরচ হয়। কিন্তু চাইলে ১০০ শতাংশ খরচ করা যায়। বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বসবাসের স্থান এত ঘিঞ্জি এলাকায় যে সেখানে করোনা সংক্রমণ বেশি। এমনও ঘটনা আছে, যেখানে মালিক শ্রমিকদের চিকিৎসা খরচ পর্যন্ত দেয়নি।’

মোশারফ হোসেন নান্নু বলেন, ‘সচেতনভাবেই মালিকরা শ্রমিকদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে আসছে। একটি সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ থাকলে অধিকার আদায় করা সম্ভব হতে পারে। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

তাসলিমা আখতার বলেন, ‘করোনা মহামারিতে পোশাক শ্রমিকদের ভোগান্তি অমানবিক। তাদের শ্রমের ওপর দিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের আয় বাড়ছে। কিন্তু, এই লকডাউনে শ্রমিকদের নূন্যতম অন্ন জুটবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

তিনি জানান, ‘এক শ্রমিক আমাকে বলছিল, “সরকার আমার পেটে লকডাউন দিয়েছে। আমি না খেয়ে মরতে চাই না, খেয়ে মরতে চাই।” শ্রমিকরা করোনার আগেও ভালো ছিল না, এখনও নেই। সব খাতের শ্রমিকরাই সব সময় অবহেলিত। পোশাক খাত সমৃদ্ধ হচ্ছে, পোশাক খাতে আয় বাড়ছে, পোশাক খাতের মালিকদের আয় বাড়ছে। কিন্তু, পোশাক শ্রমিকদের অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে মালিক পক্ষ বা সরকারের কোনো প্রকার উদ্যোগ নেই। উপরন্তু, শ্রমিকরা যাতে একত্রিত হয়ে কোনো আন্দোলন করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অপতৎপরতা সবসময়ই পরিলক্ষিত হয়।’

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘করোনায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে চিন্তা তো দূরের কথা, শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা বা সুরক্ষাটুকু নেই। ঈদের সময় শ্রমিকদের ছুটি নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, তাতে শ্রমিকদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়। শ্রমিকরা দুষ্টচক্রে আটকে আছে এবং এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে হলে শ্রমিকদের এক জোট হতে হবে।’

গবেষক ও লেখক প্রিসিলা রাজ বলেন, ‘শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে আমরা যে উদাসীন তা করোনাকালে আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। হাশেম ফুডের ঘটনা থেকে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। একটি শক্ত জবাবদিহি প্রক্রিয়া তৈরি করা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’

সভাপতির বক্তব্যে সি আর আবরার সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, ‘এই করোনা সংক্রমণকালে পরিবর্তনশীল মহামারি পরিস্থিতিতে দুঃস্থ, অবহেলিত ও অনগ্রসর শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের যথাযথ বেতন, মানবিক সহায়তা প্রদান এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরূপণে মালিকদের বাধ্য করবে কর্তৃপক্ষ। সরকার এবং মালিকরা অবশ্যই শ্রম আইন মেনে তাদের নিজ নিজ দায়দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হবেন।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here