Home Apparel ২২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভাবনা অধরা

২২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভাবনা অধরা

করোনা মহামারির জেরে বিশ্বজুড়ে কমেছে রপ্তানি। পণ্যের মান ও সাশ্রয়ী মূল্যের তাগিদে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি খাত। তবে এর মধ্যেও আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি গবেষণায় বলা হয়, যদি বাংলাদেশ পণ্যবৈচিত্র্য দিয়ে উদার বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারে, তবে বার্ষিক আরো ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।  

বাড়তি এ রপ্তানি আয় আসতে পারে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও চীনের বাজার থেকে। বর্তমানে দেশের অর্ধেকেরও বেশি পণ্য রপ্তানি হয় এ দেশগুলোতে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) পরিচালিত এ গবেষণায় বলা হয়, শীর্ষ দশ গন্তব্যে ১৮.৩৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভাবনা এখনো অধরা। যেখানে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (আরএপিআইডি) আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, শুধু চীন থেকেই কমপক্ষে চার বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে এ সুবিধা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এমনকি এক পণ্য নির্ভরতার পাশাপাশি মান সনদ নিশ্চিত করতে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও হারাচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগী ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণের ফলে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে, যা দেশের রপ্তানি খাতকে আরো বেকায়দায় ফেলে দেবে। বড় রপ্তানি বাজারগুলোর অধরা সম্ভাবনা বাংলাদেশ কেন কাজে লাগাতে পারছে না এ জন্য দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। প্রথম কারণটি হচ্ছে দেশের রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্যহীনতা। দ্বিতীয়ত, পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতে না পারা। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের কম প্রবাহও বাণিজ্য সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তারা আরো বলছেন, তৈরি পোশাক খাত ছাড়া রপ্তানির অন্য খাতগুলোতে যতটা মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। যেমন—দেশ এখনো পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ ইত্যাদি খাতের রপ্তানির যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তার ধারে কাছে যেতে পারেনি। রপ্তানিতে বেশির ভাগ জোগান দিচ্ছে পোশাক। এর বাইরে গত অর্থবছরে কৃষি, হোম টেক্সটাইল এবং পাটপণ্য ছাড়া আর কোনো খাত থেকেই এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় আসেনি। 

ইআরডির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ছয়টি রপ্তানি খাত—তৈরি পোশাক, চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক, পাদুকা এবং চিংড়ি দিয়েই রপ্তানিতে আরো ১৮.৩৪ বিলিয়ন ডলার যোগ করা সম্ভব। এ খাতগুলো থেকে এখন রপ্তানি আয় আসছে ৩১.২১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, শুধু পোশাক খাত দিয়েই রপ্তানিতে আরো ২০ বিলিয়ন ডলার যোগ করা সম্ভব। এ জন্য বর্তমান বাজারগুলোতেই মানুষের তৈরি বা কৃত্রিম সুতার পণ্য রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। পণ্যের বৈচিত্র্যীকরণে একটি উদ্ভাবনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় তাঁরা সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন বলেও জানান। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে কৃত্রিম সুতা শিল্পে বিনিয়োগ টানতে সরকার কর অবকাশ সুবিধাও দিচ্ছে।

চামড়া খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সাভার চামড়াশিল্প পার্কের জন্য লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) সনদ ছাড়া বিশ্ববাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারবেন না তাঁরা। ‘ইন দ্য শেডো অব দ্য পেনডেমিক : ইমপ্লিকেশন অ্যান্ড রিকয়ার্ড অ্যাকশন’ শিরোনামে ইআরডির এ গবেষণায় বলা হয়, শীর্ষ দশ রপ্তানি গন্তব্যের সম্ভাবনা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি কিছু কিছু বাজারের অর্ধেক সুযোগ এখনো কাজে লাগানো যায়নি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাজার এবং পণ্য দুই দিক থেকেই এখনো উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে টেকসই উত্তোরণে এ সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তাও প্রয়োজন।

গবেষণায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বর্তমানে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির পাশাপাশি আরো ৩.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এ বাজারে রপ্তানি বাড়ছে না প্রধানত কিছু শুল্ক বাধার কারণে।

ইআরডির গবেষণায় আরো বলা হয়, জার্মানির বাজারেও রপ্তানি আরো ৩.৬ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো যায়। যুক্তরাজ্যে বাড়াতে পারে ২.২ বিলিয়ন ডলার, স্পেনে ১.৭ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্সে ১.৯ বিলিয়ন ডলার, পোল্যান্ডে ১.২ বিলিয়ন ডলার, ইতালিতে ১.৩ বিলিয়ন ডলার, নেদারল্যান্ডসে ১.৬ বিলিয়ন ডলার, কানাডায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং জাপানে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। গবেষণায় আরো বলা হয়, বিদ্যমান শীর্ষ ছয়টি রপ্তানি খাতের মধ্যে শুধু পোশাক রপ্তানি করেই আরো ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করা যায়। এ ছাড়া জুতা, প্লাস্টিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া এবং চিংড়ি খাত থেকেই আরো ১.২৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, করোনা কাটিয়ে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি এসেছে ১৫.১০ শতাংশ। এ সময়ে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় এসেছে ৩১.৪৫ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি ১২.৫৫ শতাংশ। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. মো. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী আমরা পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য খাত থেকে আমাদের আয় একেবারে কম। আমরা জাপানের বাজারে পাদুকাসামগ্রী রপ্তানি করতে পারি, অথচ আমাদের মানসম্পন্ন পণ্য নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃষিপণ্যের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ রপ্তানিতে এ খাতের অংশগ্রহণ মাত্র ২.৫ শতাংশ। কম খাদ্য ও ফাইটোস্যানিটারি মানের কারণে আমরা এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছি না।’ তিনি যোগ করেন, ‘সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে বাংলাদেশকে নমুনা সনদ অর্জন করতে হবে। এ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বীকৃতির চুক্তি রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের এমন চুক্তি নেই।’

হালাল খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজার ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘এ বাজারে আমাদের রপ্তানি প্রায় শূন্য, কারণ আমাদের হালাল সনদের ব্যবস্থা নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ পণ্যেরই কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। বন্ড সুবিধায় তৈরি পোশাকের কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আনা গেলেও অন্য পণ্যগুলো এ সুবিধা থেকে  বঞ্চিত। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি আলাদা আলাদা দেশের সঙ্গে স্বাক্ষর করা দরকার হলেও ভুটান ছাড়া কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের এমন চুক্তি নেই।’ চীনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘দেশটির বিশাল বাজারে পণ্য রপ্তানিতে আমরা লিড টাইমের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেতে পারি, অথচ এদিকে আমাদের খুব একটা নজর নেই।’ 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ চীন বছরে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য আমদানি করে। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চীনা কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ দেশটিতে এ সময়ে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, যার ৪০ শতাংশই তৈরি পোশাক। অথচ ২০১১ সাল থেকেই এলডিসির আওতায় চীন বাংলাদেশের বেশির ভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এমনকি গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ শূন্য শুল্ক সুবিধা মোট আট হাজার ২৫৬ পণ্যে বাড়ানো হয়েছে।

সম্প্রতি আরএপিআইডির চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দল যে গবেষণা করেছে তাতে বলা হয়, চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কমপক্ষে চার বিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত। বাংলাদেশ চীনের বাজারে তার রপ্তানি সম্ভাবনার ৩০ শতাংশই কাজে লাগাতে পারেনি।

রপ্তানিকারক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বাজার ধরার জন্য যে ধরনের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন, তা সেখানে নেই। নিজের একজন বায়ারের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ওই ক্রেতা আমার কাছে তৈরি পোশাকের এমন একটি পণ্য চেয়েছিলেন, যেটি নায়লন এবং পলিয়েস্টারে তৈরি। কিন্তু অর্ডারটি আমি নিতে পারিনি, কারণ আমরা তো এ ধরণের পোশাক তৈরি করি না।’ চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মুনশি ফায়াজ আহমেদ বলেন, ‘চীন বাংলাদেশকে অনেক সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তারা যা চায় তা যদি আমরা তৈরি করে দিতে না পারি তাহলে তো রপ্তানি বাড়বে না। এমনকি চীনের বাজারে রপ্তানি কিভাবে বাড়ানো যায় এ নিয়ে আমাদের সংগঠিত কোনো গবেষণাও নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘চীন যেসব পণ্য তৈরি করে তার অনেক খুচরা অংশ অন্য দেশ থেকে তৈরি করে আনে। আমরা সেদিকেও নজর দিচ্ছি না।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিপণ্যের প্রায় সবটাই হচ্ছে ফিনিশড বা সম্পন্ন পণ্য। আমরা বিভিন্ন পণ্যের সংযুক্ত অংশ রপ্তানির সুযোগ নিতে পারছি না। অথচ চীন তাদের অনেক পণ্যের সংযুক্ত অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে। বাংলাদেশ এ সরবরাহ চেইনের অংশীদার হতে পারে।’ এ ছাড়া চীনা বাজারে রপ্তানির জন্য স্থানীয় পণ্যে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের যে বাধ্যবাধকতা তাও রপ্তানি বৃদ্ধিতে অন্যতম বাধা বলে জানান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সূত্র : বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here