Home বাংলা নিউজ তৈরি পোশাকের তীব্র কার্গো জটে নাকাল ঢাকা বিমানবন্দর

তৈরি পোশাকের তীব্র কার্গো জটে নাকাল ঢাকা বিমানবন্দর

আন্তর্জাতিক পোশাক ব্র্যান্ডের ক্রেতাদের তুমুল চাহিদার কারণে বিপুলসংখ্যক কনটেইনার কার্গোর চাপ পড়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর। সূত্র জানিয়েছে, এ কারণে বিমানবন্দরকে সক্ষমতার চেয়ে দেড়গুণ বেশি কার্গো সামলাতে হচ্ছে।

ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের কন্টেইনার জট এবং চড়া কার্গো শিপিং চার্জের কারণে ক্রেতা ও রপ্তানিকারকরা আকাশপথে পণ্য পরিবহনে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু বিমানবন্দরের স্ক্যানার ও ওজন মেশিন বিকল থাকায় এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলমান থাকা ও কার্গো ভিলেজে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার কারণে অতিরিক্ত চাপ সামলাতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘এয়ারলাইন সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা দিনে ৬০০-৭০০ টন পণ্য সামলাচ্ছি। যা আগের ধারণক্ষমতার তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বেশি’

তিনি আরও বলেন, ‘কার্গো ফ্লাইটের সংখ্যা ১৫টি থেকে বাড়িয়ে ২৫টি করা হয়েছে। 

‘গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পোশাকের কার্গো বাড়ছে। আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সব কার্গো সময়মতো ওড়ানোর চেষ্টা করছি।’

ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা জানিয়েছেন, ঢাকা বিমানবন্দর এখন যেসব পণ্য সামলাচ্ছে, তার ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক।

ফ্রেইট ফরোয়ার্ড নেতারা বলছেন শিডিউলড ফ্লাইট না থাকা, বিস্ফোরক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা (ইডিএস) বিকল হয়ে যাওয়া এবং তৃতীয় টার্মিনালের চলমান নির্মাণকাজ—এই তিন কারণে ঢাকা বিমানবন্দর কার্গো সামলানোর ক্ষমতা হারিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফরওয়ার্ডার বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত বাড়তি চাপ সামলানোর জন্য ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানো।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘মহামারির কারণে দোকান প্রায় ফাঁকা বলে আমাদের অনেক ক্রেতা এয়ার ফ্রেইটে পণ্য পাঠাতে বলছে।’ অন্যদিকে গন্তব্যের ভিত্তিতে কার্গো শিপিং চার্জ ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শহীদুল্লাহ আজিম আরও জানান, পোশাক প্রস্তুতকারকদের হাতে আরও বিপুলসংখ্যক কার্যাদেশ রয়েছে। এর ফলে এই চাপ আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘পোশাক পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ের কাজের গতি আরও বাড়ানোর জন্য বিজিএমইএ ইতিমধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে।’

আন্তর্জাতিক ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, ডেমোট্রান্সের মালিক নুরুল ইসলাম বাবু বলেন, আমরা সাধারণত এক মাসে ২০ টন পণ্য হ্যান্ডেল করি করি। এখন সেটা বেড়ে ৪০ টনে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সেক্রেটারি মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘গত দেড় মাস ধরে পণ্য লোড ও আনলোড করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো কন্টেইনার জট নেই। তবে আমাদের জানামতে কিছু ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে কয়েকদিন আগে কনটেইনার জট সৃষ্টি হয়েছিল।’

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, শিডিউলড ফ্লাইট না থাকায় রপ্তানিকারকরা এখন বলতে গেলে মালবাহী বিমানের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অথচ এসব মালবাহী বিমান দেশে নিয়মিত কাজ করছে না।

তিনি বলেন, ‘এ সময়ই পোশাক রপ্তানি হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একটা বিস্ফোরক শনাক্তকরণ সিস্টেম (ইডিএস) মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে, আরেকটাকে কিছুক্ষণ কাজ করার পর বিশ্রাম দিতে হয়। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানির জন্য বিস্ফোরক শনাক্তকরণ স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন বিস্ফোরক শনাক্তকারী ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে এরকম বিস্ফোরক স্ক্যানিং করছি।’

বিএএফএফএ সভাপতি জানান, তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ চলমান থাকার কারণে কার্গো ভিলেজে একটা অংশ বন্ধ হয়ে আছে। ফলে পণ্য সামলানোর প্রক্রিয়া আরও ধীর হয়ে গেছে।

কবির আহমেদ বলেন, বিমানবন্দরে কার্গো জটের পেছনে এগুলোও অন্যতম কারণ।

পোশাক রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত বিমান চলাচল না থাকায় তাদের কার্গো ট্রাকগুলোকে কার্গো ভিলেজের বাইরে ৩ থেকে ১০ দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ তাদের যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অন্যদিকে গন্তব্যের ভিত্তিতে বিমানভাড়াও ৬০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

নারায়ণগঞ্জভিত্তিক এম.বি. নিট ফ্যাশন-এর মালিক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কার্গো ভিলেজে ঢোকার জন্য ৩ দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলে আমার দুটি কার্গো ট্রাক ট্রাফিক পুলিশের মামলা খেয়েছে।

‘আমার ইটালিয়ান আর সুইডিশ ক্রেতারা তাদের দোকান প্রায় ফাঁকা থাকায় জরুরি ভিত্তিতে এসব পণ্য পাঠাতে বলেছেন।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘কার্গো সংকটের কারণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কার্গো জোনে আমাদের কার্গো ১০ দিন ধরে আটকে আছে।’

মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘পণ্যগুলো যদি সমুদ্রপথে পাঠানো হয়, তাহলে ক্রেতারা এই সেশনে পণ্য না-ও পেতে পারে। এ কারণে আমরা পোশাক নির্মাতারা সময়স্বল্পতার কারণে এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু আকাশপথেও আমরা একই সমস্যায় পড়ছি।’

তিনি জানা, সময়মতো পণ্য না পেলে ক্রেতারা রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বায়িং হাউস পার্টনার বলেন, ‘আমরা আমাদের ডেডলাইন বজায় রাখার জন্য এক কোরিয়ান ক্রেতার কাছে এয়ার ফ্রেইটে ৬ হাজার ৬০০ কেজি পণ্য পাঠিয়েছি। কিন্তু এয়ারফ্রেইটের খরচ আগেরবারের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি দিতে হয়েছে, ছিল। এটা পণ্যের দামের প্রায় অর্ধেক।

‘ঢাকা থেকে সিউলে এয়ারফ্রেইটে প্রতি কেজি পণ্য পাঠানোর খরচ ছিল ২ দশমিক ৪ ডলার, এখন এই খরচ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ ডলার।’

পুল অ্যান্ড বিয়ার কলকাতা বিমানবন্দরের মাধ্যমে পণ্য পাঠাতে বলেছে
স্প্যানিশ পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পুল অ্যান্ড বিয়ার ইতিমধ্যে তাদের বাংলাদেশি সাপ্লায়ারদের বলে দিয়েছে ঢাকা বিমানবন্দরের পরিবর্তে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে যেন তাদের পণ্য পাঠানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো চিঠির একটা কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পরিমাণে বেশি হওয়ায় এবং বিরামহীন সমস্যার কারণে ঢাকা বিমানবন্দরে স্ক্যানারের জন্য তাদের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই এই সপ্তাহে তাদের কার্গোর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ (৫০০/১২০০ টন) কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিজিএমইএ-র ভাইস শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এর জন্য আমাদের ব্যবসাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

রপ্তানি ও বাজারের অবস্থা
২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে বাংলাদেশ পোশাক পরিবহনের সুবাদে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার।

পোশাক আইটেমের সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ার কারণে আগের মাস থেকে আগস্টে যুক্তরাজ্যে খুচরা বিক্রি কমা অব্যাহত ছিল। তবে বর্তমানে বিক্রির পরিমাণ ০.৭ শতাংশ হারে বাড়ছে।

মহামারি ও সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ায় আগস্টে আমেরিকায় বিক্রি বেড়েছে। 

মহামারিতে প্রায় দেড় বছর কাটানোর পর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের খুচরা বিক্রেতারা বড়দিনের ব্যবসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here