Home বাংলা নিউজ পোশাকশিল্পে বিপুল অর্ডার, প্রচুর চাকরি

পোশাকশিল্পে বিপুল অর্ডার, প্রচুর চাকরি

বিকেএমইএ-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই প্রচুর অর্ডার আসছে। আমরা অভিভূত। করোনার মধ্যে এত অর্ডার পাব ভাবতে পারিনি। অনেক কারখানা দুই বছরের অর্ডার নিয়ে ফেলেছে। সেগুলো সময়মতো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেই বাড়তি জনবল প্রয়োজন। সে জন্যই নতুন কর্মীর খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে কারখানাগুলো।’

রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের একটি পোশাক কারখানার ফটকে সাঁটানো একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চোখ আটকে গেল। ১০০ জন অপারেটর ও ২০০ জন হেলপার (শিক্ষানবিশ শ্রমিক) নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। অক্টোবরের ৭ তারিখের মধ্যে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

গত পাঁচ বছর এমন বিজ্ঞপ্তি দেয়নি কারখানাটি। প্রতিষ্ঠানের নাম এবং নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ম্যানেজার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রচুর অর্ডার আসছে। দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তাই মালিক জরুরি ভিত্তিতে নতুন কর্মী নিতে বলেছেন। সে কারণেই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।’

চাকরির বাজারে এমন সুখবর এখন দেশের প্রায় সব পোশাক কারখানায়। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুসংবাদ দিচ্ছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

শুধু মিরপুরের এ কারখানা নয়, রাজধানী ও আশপাশের জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও চট্টগ্রামের পোশাক কারখানাগুলোর ফটকে টানানো হচ্ছে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।

এ এক অচেনা দৃশ্য। গত চার-পাঁচ বছরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি কারও।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই প্রচুর অর্ডার আসছে। আমরা অভিভূত। করোনার মধ্যে এত অর্ডার পাব ভাবতে পারিনি। অনেক কারখানা দুই বছরের অর্ডার নিয়ে ফেলেছে। সেগুলো সময়মতো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেই বাড়তি জনবল প্রয়োজন। সে জন্যই নতুন কর্মীর খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে কারখানাগুলো।’

শুধু একটি-দুটি কারখানা নয়, সব কারখানা এখন এমন বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে বলে জানান হাতেম।

একই কথা বলেন ওভেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখনও সঠিকভাবে কোনো তথ্য বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা বিজিএমইএ সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে যেটা আভাস পাচ্ছি, আগামীতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে পোশাকশিল্পে। সব মালিক এখন ব্যস্ত। এমন ব্যস্ততা চার-পাঁচ বছরে চোখে পড়েনি।

‘সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে, ক্রেতারা এখন বেশি দামে পোশাকের অর্ডার দিচ্ছে। প্রচুর অর্ডার মিলছে। এই বাড়তি অর্ডার বায়ারদের সময়মতো দিতে তো বাড়তি লোক লাগবেই। সে জন্যই কারখানার মালিকরা নতুন লোক নিয়োগ দিচ্ছেন।’

আগামী এক বছরে পোশাক কারখানার কী পরিমাণ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তরে রুবেল বলেন, ‘সেটা আসলে সঠিকভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। আমরা বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে সার্ভে করছি। কিছুদিন পর বলতে পারব। তবে আমার নিজের কারখানার চাহিদা থেকেই বলতে পারি, প্রচুর কর্মী লাগবে আমাদের পোশাক খাতে।’

একটি উদাহরণ দিয়ে পোশাক খাতের এ তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার এক বন্ধু তার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে। এ জন্য শ্রমিকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত তিন মাসে তারা প্রায় এক হাজার শ্রমিক নিয়োগও দিয়েছে। আগামী এক মাসে আরও ৫০০ শ্রমিক নেবে। নতুন লোকবল নিয়োগের আগে কারখানাটিতে কাজ করতেন আড়াই হাজার কর্মী।

‘এই কারখানার মতো রপ্তানিমুখী অনেক পোশাক কারখানাই এখন উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। আবার আগের তুলনায় ক্রয়াদেশে কম লিড টাইম (ক্রয়াদেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) দেয়ায় অল্প সময়ে বেশি পণ্য উৎপাদনের চাপ তৈরি হয়েছে। এ দুই কারণেই মূলত নতুন শ্রমিক নিয়োগের হার বেড়েছে।’পোশাকশিল্পে বিপুল অর্ডার, প্রচুর চাকরি

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘২০১৯ সালের তুলনায় পোশাকের ক্রয়াদেশ ১০-১৫ শতাংশ বেশি আসছে। বাড়তি ক্রয়াদেশের ফলে ৫-৭ শতাংশ শ্রমিক নিয়োগ বাড়তে পারে। তাতে আড়াই লাখের কিছু কম-বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।’

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যার সঠিক কোনো হিসাব নেই। তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্রের (সিইডি) ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে রপ্তানিমুখী ৩ হাজার ৩৮৪ পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ২৬ লাখ ৬৬ হাজার শ্রমিক। এর মধ্যে ১১ লাখ ১৩ হাজার পুরুষ ও ১৫ লাখ ৫৩ হাজার নারী।

ম্যাপড ইন বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ও বিজিএমইএ-এর দাবি আমলে নিলে বাড়তি ক্রয়াদেশের কারণে ৫-৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৩৩ হাজার থেকে ১ লাখ ৮৬ হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ হতে পারে পোশাকশিল্পে। তবে ৩ হাজার ৩৮৪ কারখানার মধ্যে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা ৬৭৫। ফলে নতুন শ্রমিক নিয়োগের সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। আবার করোনাকালে ছাঁটাই হওয়া অনেক শ্রমিকও আবার নিয়োগ পাচ্ছেন।

এ তথ্য নিয়ে বিজিএমইএ নেতা মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘আসলে বিজিএমইএ-বিকেএমইএ-এর সদস্যের বাইরেও এক হাজারের মতো কারখানা আছে, যেগুলোতেও ভালো মানের পোশাক তৈরি হয়; কাজও করেন অনেক শ্রমিক। এ ছাড়া পোশাকশিল্পের পশ্চাৎ সংযোগ অন্য কারখানাও আছে এক হাজারের মতো।’

সব মিলিয়ে শ্রমিকের সংখ্যা যোগ করলে ৪০ থেকে ৪২ লাখের মতো হবে বলে জানান রুবেল।

পোশাক খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি স্নোটেক্স গ্রুপ। তারা বছরে ২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। তাদের স্নোটেক্স আউটারওয়্যার ও স্নোটেক্স স্পোর্টসওয়্যারে ৬ হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছে। আরও ১ হাজার নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা হবে।

স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, ‘২০১৯ সালের তুলনায় আমাদের ক্রয়াদেশ বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ। সক্ষমতা আরও বেশি হলে ক্রয়াদেশ আরও বেশি নেয়া যেত।’

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বড়দিনকে কেন্দ্র করেও প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে।

তার আগেই চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সম্প্রতি ভিয়েতনামে করোনার লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে।

চট্টগ্রামের ‘ডেনিম এক্সপার্ট’ ক্রয়াদেশ বাড়ায় গত তিন-চার মাসে ৩৫০ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে। আরও সাড়ে তিন শ শ্রমিক নেবে তারা।

এ তথ্য দিয়ে ডেনিম এক্সপার্টের এমডি মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ক্রয়াদেশ দিতে আগ্রহী ক্রেতাদের ফোন প্রতিদিনই পাচ্ছি। ক্রয়াদেশের এমন চাপ গত পাঁচ বছরে পাইনি। তবে বর্তমানে বড় সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকের সংকট। চাহিদা অনুযায়ী লোক পাচ্ছি না। সে কারণে উৎপাদনক্ষমতাও বাড়ানো যাচ্ছে না।’

করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে পোশাক রপ্তানি এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ভালো হয়নি। তবে আগস্টে ২৭৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ক্রেতারা আগের চেয়ে কম লিড টাইমে পোশাকের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তাই অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য লোকবল নিয়োগ বেড়েছে। তাতে পুরো খাতে বর্তমান জনবলের চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি নতুন কর্মসংস্থান হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here