করোনাভাইরাসে
শ্রমিকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সময়মতো শ্রমিকরা বেতন পাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা
হক। তিনি সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তিনি আমাদের
পাশে আছেন। শুধু গার্মেন্ট শ্রমিক নয়, সব শ্রমিকের
কথাই ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী।’ সোমবার এক ভিডিওবার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
অপরদিকে
স্পর্শকাতর গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে দ্রুত সঠিক সমাধান চেয়েছেন মালিকরা। তাদের
অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, মূল্যবান সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসকে
সত্যিকারার্থে মোকাবেলা করতে হলে সবার আগে এই সেক্টর নিয়ে দ্রুত
সিদ্ধান্ত দিতে হবে। কেননা এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেড় কোটি লোকের
কর্মসংস্থান জড়িত। দুপুরে ৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের এক ভিডিওবার্তায় বিজিএমইএ
সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘আমরা সবাই দুরূহ ও অস্বাভাবিক সময়ের মধ্য দিয়ে
যাচ্ছি।
অর্ডার
পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। গত ৪ দিনে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের অর্ডার
বাতিল হয়েছে। কেউ কেউ পুরো অর্ডার বাতিল করেছেন,
আবার কেউ আংশিক। অনেক
ক্রেতা আলোচনার কথা বলছেন। আলোচনা করার কথা বললেও একটা আশা থাকে। কিন্তু
বাতিল করে দিলে কোনো জায়গা থাকে না। ক্রেতারা এই মৌসুমের পণ্য আগামী মৌসুমে
নেবে কি না, সেটাও বলছে না। এ অবস্থায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
এই দেড় বিলিয়ন ডলার বাতিল বা স্থগিত করায় প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত
হবেন।
এটা
শুধু বিজিএমইএর ওয়েবসাইটে গার্মেন্ট মালিকদের দেয়া তথ্য। এর বাইরেও প্রচুর
অর্ডার বাতিল হয়েছে।’ শ্রমিকদের উদ্দেশে রুবানা হক বলেন, ‘এ অবস্থায় ধৈর্য
হারালে হবে না। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সবাই
তার ভাষণের জন্য আপেক্ষা করি। আতঙ্কিত হওয়ার জায়গা নেই। শ্রমিকদের যখন বেতনের
সময় আসবে তখন তারা বেতন পাবেন। কেউ ভয় পাবেন না। ভরসা রাখুন। সরকারের
সর্বোচ্চ পর্যায় আমাদের আশ্বস্ত করেছে, তারা আমাদের পাশে আছে।
অন্তত
প্রধানমন্ত্রীর ওপর এটুকু ভরসা রাখুন, শুধু গার্মেন্টের ৪১ লাখ শ্রমিকের দিকে
নয়, উনি সব
শ্রমিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। যতদিন উনি পাশে আছেন,
আমরা কেউ পানিতে পড়ব না। বিদেশি
ব্র্যান্ডকে আবেদন জানাই, তারা যেন বানানো মালগুলো নেয়। অন্তত চলার জায়গা তৈরি করুন। না হলে আগামী ৬
মাসে বড়, মাঝারি ও ছোট সব কারখানা বসে যাবে।’
সংবাদকর্মীদের
উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের তাৎক্ষণিক একটি হেডলাইন, স্ক্রল এ
মুহূর্তে পোশাক শিল্পের জীবন বদলে দিতে পারে। যদি কোনো ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি
হয়, না
শ্রমিক ভাই-বোনরা উপকৃত হবে, না বিজিএমইএ উপকৃত হবে, না শিল্প উপকৃত হবে, না সরকার উপকৃত হবে। শ্রমিক বেতনের সময় তার বেতন পাবে। এটি
মনে রেখে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।’
তিনি
আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের মাস্ক দেয়া চলছে,
ডাক্তারদের পোশাক তৈরির কাজ চলছে।
যেখানে পারছি করছি, আর যেখানে পারছি না সেখানে অন্তত রেইনকোর্ট কিনে সামনে
মাস্ক দেয়া হচ্ছে। যাতে ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। বিজিএমইএ সব
সময় শ্রমিকদের পাশে আছে।’
এদিকে
এফবিসিসিআইর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিজিএমইএ-কে কারখানা মালিকরা যে তথ্য জানিয়েছে,
তাতে দেড় বিলিয়ন ডলারের অর্ডার
বাতিল হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অর্ডার বাতিলের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন
ডলার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তের ক্রেতাদের ই-মেইল পাওয়ার শঙ্কায়
রয়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত সঠিকভাবে
বলা যাবে না কী পরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়েছে।’
নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গার্মেন্ট মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা দেখতে
পাচ্ছি অর্ডার বাতিলের তথ্য নিয়ে দায়িত্বশীল কেউ কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্য
দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, কোনো কারাখানায় অর্ডার নেই। যা ছিল সব বাতিল হয়ে
গেছে। ফলে আমাদের উচিত হবে, কঠিন সত্যকে মেনে নিয়ে তা মোকাবেলা করার জন্য
সরকারের সহযোগিতায় কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া। যা অন্যান্য দেশ করছে। কিন্তু
এভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।
প্রথমসারির
একজন গার্মেন্ট মালিকের কারখানায় যদি কোনো অর্ডার না থাকে তাহলে অন্য
কোথাও অর্ডার থাকার কথা নয়। সুতরাং নজিরবিহীন এ পরিস্থিতিতে সবার উচিত হবে, সরকারপ্রধানকে
প্রকৃত তথ্য জানানো। পাশাপাশি অন্তত আগামী ৩ মাস কীভাবে
গার্মেন্ট চলবে তার পলিসি নির্ধারণ করা। সে ক্ষেত্রে এমন প্রস্তাব দেয়া
যেতে পারে, এক মাসের বেতন দিয়ে গার্মেন্ট কর্মীদের ছুটি দিতে হবে।
একই সঙ্গে সরকার অবশিষ্ট ২ মাসের বেতন ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা
করবে।
যা
গার্মেন্ট মালিকরা ৩-৪ বছর মেয়াদে পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করবেন। সে ক্ষেত্রে
সরকার ব্যাংকে কিছু ভর্তুকি দিতে পারে। কেউ কেউ বলেন, এ সেক্টর ভালোভাবে
টিকিয়ে রাখতে কমপক্ষে আগামী ৩ মাসের পুরো তহবিল সরকারের পক্ষ থেকে বহন
বরা উচিত। কেননা, এই গার্মেন্ট সেক্টর জাতিকে অনেক দিয়েছে। তারা বলেন, গার্মেন্ট
শ্রমিকরা সামান্য বেতন পায়। তাই বেতনের নিশ্চয়তা না থাকলে তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ
সামাল দেয়া কঠিন হবে। সঙ্গত কারণে বিজিএমইএ নেতারাসহ সরকারের
উচ্চপর্যায়কে গার্মেন্ট সেক্টরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ সেক্টরের
বিষয়ে আরও আগে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল। ইতোমধ্যে অনেক
দেরি হয়ে গেছে।
ভুক্তভোগী
কারখানা মালিকরা বলছেন, অনেক ক্রেতা ই-মেইলে সরাসরি অর্ডার বাতিল না
করলেও উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলছেন। পরে তারা এ বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে
জানাচ্ছেন। কিন্তু এতেও আশঙ্কা আছে। কারণ, গার্মেন্টপণ্য মৌসুম অনুযায়ী বানানো হয়। আর
প্রতিটি মৌসুমেই হালনাগাদ ডিজাইন পাঠান ক্রেতারা। তার মানে, এ বছরের
ডিজাইন আগামী বছর পুরনো হয়ে পড়বে। তখন ওই পণ্য ক্রেতারা আদৌ নেবেন কি না, তা নিয়ে
যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ কারণে যেসব অর্ডার নিয়ে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো
প্রকৃতপক্ষে কৌশলে বাতিল করে দিয়েছেন ক্রেতারা।
নিট
কারখানা খোলা থাকবে : সোমবার বিকালে কারওয়ান বাজারে বিকেএমইএর সম্মেলন
কক্ষে সংগঠনের সভাপতি ও সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সভাপতিত্বে পরিচালনা
পর্ষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিট কারখানা খোলা রাখাসহ ৩টি সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বিকেএমইএ।
বিজ্ঞপ্তিতে
বলা হয়েছে, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬ ও ২৭ মার্চ কারখানায় সব
ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা প্রতিরোধে কারখানায় প্রবেশমুখে সব
শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জীবাণুনাশক সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত
ধোয়া এবং শরীরের তাপমাত্রা মেপে কারখানায় প্রবেশ করাতে হবে। এ ছাড়া কারখানার
ভেতরে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এতে
আরও বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিকনির্দেশনার
আলোকে এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ফ্যাক্টরি খোলা বা বন্ধ
রাখা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ ছাড়া কারখানার কী পরিমাণ
অর্ডার বাতিল, স্থগিত এবং শিপমেন্ট বাতিল হয়েছে, তা ৩১ মার্চের মধ্যে
ফ্যাক্টরিগুলো থেকে লিখিতভাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।