নানামুখী
চ্যালেঞ্জের পরও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে
পোশাক রপ্তানি পৌনে তিন গুণ বেড়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাক রপ্তানিতে
বাংলাদেশ দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়। নতুন বাজারেও ভালো করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ
দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে
পোশাক রপ্তানি ছিল মাত্র ৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয় ১ হাজার
২৪৯ কোটি ডলারে। গত অর্থবছর পোশাক রপ্তানি হয় ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের। তার মানে ৩৬
বছরের ব্যবধানে পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ১ হাজার ১৩৩ গুণ। আর সর্বশেষ দশ বছরে বেড়েছে
পৌনে তিন গুণ। বছরের পর বছর ধরে সরকারের নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা, সস্তা শ্রম আর উদ্যোক্তাদের
অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের পোশাকশিল্প শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান,
সহযোগী উপখাত আর কোটি কোটি ডলারের রপ্তানির কারণে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক
ভূমিকা রাখছে পোশাকশিল্প।
পোশাকের ব্যবসায়
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। শুরু হয়েছে মূল্যযুদ্ধ। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রতিযোগিতা
সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে বাংলাদেশের
ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে।
চ্যালেঞ্জের
মধ্যেও পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। বিশ্বের শীর্ষ দশ রপ্তানিকারক দেশ
গত বছর ৭২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে চীন একাই রপ্তানি
করেছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা
চীনের বিকল্প উৎপাদক দেশ খুঁজছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির মাত্র ৬ দশমিক ৪
শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। ফলে বাকি ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ হিস্যায় ভাগ বসিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির
সুযোগ রয়েছে।
পোশাকের ব্যবসায়
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ আসছে, শুরু হয়েছে মূল্যযুদ্ধ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতা
সক্ষমতা কমছে
জানতে চাইলে
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন,
‘যত চ্যালেঞ্জ থাকে ততই সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদের পণ্য বহুমুখীকরণে যেতে হবে। আমাদের
পোশাকের ডিজাইনে ইনোভেশন আনতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে চলে যাচ্ছি আমরা। সেটির
জন্যও প্রস্তুতি দরকার।’
রানা প্লাজার
ধাক্কা
২০১৩ সালের
২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় পোশাকশিল্পের ভিত নড়ে যায়। ১ হাজারের বেশি
শ্রমিক নিহত হওয়ায় ব্যবসা ফিরে যাওয়ার একের পর এক হুমকি এলেও উদ্যোক্তা ও সরকারের চেষ্টায়
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। ভবনধসের পর বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ কারখানার তকমা পাওয়া বাংলাদেশই
হয়ে উঠেছে নিরাপদ কারখানার বড় বিজ্ঞাপন। গত ছয় বছরে দেশে এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক
কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা।
তারপরও জাতীয়
ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে থাকা ৬৮৬ কারখানা গলার কাঁটা হয়ে আছে। বারবার
তাগিদ দিয়েও মালিকদের গাফিলতির জন্য কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে।
সস্তা বনাম
দামি পোশাক
ছেলে ও মেয়েদের
শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি–শার্ট ও সোয়েটার থেকে দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির ৬১
শতাংশ আয় হয়। আবার পোশাকশিল্পের রপ্তানির ৭৩ শতাংশই এই পাঁচ পণ্যের দখলে। সব মিলিয়ে
দেশের রপ্তানি বাণিজ্য অনেকটাই পাঁচটি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। বিদায়ী অর্থবছরে ৩ হাজার
৪১৩ কোটি ডলার। এই রপ্তানির ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি–শার্ট
ও সোয়েটার থেকে এসেছে।
সস্তা পণ্যের
পাশাপাশি বেশি দামের বা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য যেমন—স্যুট, ব্লেজার, অন্তর্বাস, সাঁতারের
পোশাক উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে সেটি এখনো বড় আকারে যায়নি। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বর্তমানে
রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হলে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যই বড় ভরসা।
জানতে চাইলে
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল প্রথম
আলোকে বলেন, ‘আমরা সস্তা পোশাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছি। তবে গত কয়েক বছরে শ্রমের
মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুৎ, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে
সস্তা পোশাক উৎপাদনকারীরা চাপে পড়েছেন। পোশাক রপ্তানিকে টেকসই করতে হলে প্রধান পাঁচ
পণ্যের পাশাপাশি বেশি দামের পোশাক তৈরির দিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ,
বিশেষ করে চীনাদের পশ্চাৎ–মুখী শিল্পে আকৃষ্ট করতে হবে।’
ভবিষ্যতের
প্রস্তুতি এখনই
নিট পোশাকের
৮০-৮৫ শতাংশ কাপড় দেশে উৎপাদন হলেও ওভেন পোশাক তৈরির ৬৫-৭০ শতাংশ কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি
হয়েছে। অন্যদিকে পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বোতাম, লেবেল, কার্টুনসহ অন্যান্য সরঞ্জামের
প্রায় ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদন হচ্ছে। মূলত ওভেন কাপড় উৎপাদনে পিছিয়ে থাকার জন্যই মূল্য
সংযোজন বাড়ছে না। এ জন্য বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করে বস্ত্রকল মালিকদের
সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক
অঞ্চলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমি ও কিছু নীতিসহায়তা দিলেই বস্ত্রকলে বিনিয়োগে আগ্রহী
হবেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশের
তৈরি পোশাক রপ্তানির ৬১-৬২ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হলে
২০২৭ সালের পর অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা থাকবে না। তখন শুল্কমুক্ত
সুবিধা পেতে হলে জিএসপি প্লাসের যোগ্য হতে হবে। সেটির জন্য আলোচনা হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি
নেই।
পোশাক রপ্তানিতে
লিড টাইম (পণ্য উৎপাদন থেকে জাহাজে তুলে দেওয়া পর্যন্ত সময়) বড় প্রভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। আবার ঘন ঘন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর
কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েন।
বেসরকারি
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে
বলেন, ‘পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের দীর্ঘদিন স্বস্তিকর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ছিল। সেই
জায়গায় অন্য দেশগুলো ভাগ বসাতে শুরু করেছে। আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কারখানার উৎপাদনশীলতা
বৃদ্ধি, পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তি উন্নয়নে সরকারের নীতি ও প্রণোদনার
কাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে।’
শ্রমিকের
অধিকার
গত ডিসেম্বর
ও জানুয়ারিতে নতুন মজুরিকাঠামোর অসংগতি দূর করতে আন্দোলনে নামেন পোশাকশ্রমিকেরা। সেটি
দমাতে গিয়ে শিল্পমালিকেরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা করেন। ১১ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই
করা হয়। বিষয়টি নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১০টি
তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকি মামলা প্রত্যাহারের জন্যও চাপ আছে।
রানা প্লাজা
ধসের পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পোশাকশিল্পে ৬৯৩টি ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। তবে শ্রমিকনেতাদের
দাবি, অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়নই মালিকপক্ষের চাপের মুখে অকার্যকর। নতুন করে ট্রেড ইউনিয়নের
নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলেও নানা অজুহাতে তা বাতিল করা হচ্ছে।
শ্রমিকনেতা
বাবুল আখতার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম অধিকার নিশ্চিতে শ্রম আইন সংশোধন ও কার্যকর
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা না গেলে পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।