Home Business জাপানের ফ্যাশনজগতে চাকচিক্যের চমক এনে দেওয়া শিল্পী

জাপানের ফ্যাশনজগতে চাকচিক্যের চমক এনে দেওয়া শিল্পী

সম্প্রতি মারা গেছেন বিশ্বখ্যাত জাপানি ফ্যাশন ডিজাইনার কানসাই ইয়ামামোতো। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন মনজুরুল হক।

ফ্যাশন ডিজাইনকে শিল্পকলা হিসেবে দেখার সুযোগ আমাদের অঞ্চলে এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। পশ্চিমের দেশগুলোতে এই শিল্প অবশ্য অনেক দিন থেকেই স্বীকৃত এক শিল্পকলা। এর স্রষ্টারা শিল্পকলার অন্যান্য শাখার মতোই জনপ্রিয় ও সমাদৃত। এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও নানা রকম মাপকাঠিতে জাপানকে দৃশ্যত পশ্চিমের একটি দেশ বলে মনে করা হয় বলে জাপানও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে ১৯৬০–এর দশক থেকে জাপানের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হতে শুরু করলে নানা দিক থেকে দেশটি পশ্চিমের সমকক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন ডিজাইন জাপানে শিল্পকলার স্বীকৃতি লাভ করে। জাপানের বেশ কয়েকজন ডিজাইনার বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সম্মানিত। তাঁরা সবাই কাজ করছেন নিজস্ব ধারায়। বলার কথা হলো, সেই সব ধারায় জাপানি সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট, যা তাঁদের পশ্চিমের ফ্যাশন ডিজাইনারদের চেয়ে ভিন্ন অবস্থানে স্থান করে নিতে সাহায্য করেছে। জাপানের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মুষ্টিমেয় গুটিকয় ফ্যাশন ডিজাইনারের অন্যতম কানসাই ইয়ামামোতো। গত ২১ জুলাই টোকিওর একটি হাসপাতালে ৭৬ বছর বয়সে প্রাণ ত্যাগ করেছেন তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি লিউকেমিয়ায় ভুগছিলেন।

সমসাময়িক অন্য কয়েকজন খ্যাতিমান ফ্যাশন ডিজাইনারের তুলনায় কানসাই ইয়ামামোতো তত ব্যাপক খ্যাতি অর্জন না করলেও তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে জাপানের ফ্যাশন ডিজাইনকে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। জাঁকজমকপূর্ণ বাহারি রঙের শোভায় কিছুটা অতিবাস্তবতার ছাপযুক্ত তাঁর নকশা করা পোশাক ১৯৭২ সালে লন্ডনে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়; এবং সে সময়ই তা অনুরাগীদের নজর কেড়েছিল। কানসাই ইয়ামামোতোর আগে জাপানের কোনো ফ্যাশন ডিজাইনার পশ্চিমের কোথাও তাঁদের কাজ নিয়ে যাননি। কানসাই ইয়ামামোতোই জাপানি পোশাক নকশাকারদের ওই পথ দেখিয়েছিলেন।

ইয়ামামোতোর জন্ম ১৯৪৪ সালে জাপানের বন্দরনগরী ইয়োকোহামায়, দেশের সামনে দেখা দেওয়া কঠিন এক সময়ে। তাঁর শৈশব পার না হতেই যুদ্ধে পরাজিত জাপানকে ভয়ানক এক দুর্যোগের মধ্যে পড়তে হয়। চারদিকে তখন ছিল ক্ষুধা আর অভাবের রাজত্ব। ফলে কৈশোরে ইয়ামামোতো বঞ্চিত হয়েছিলেন শিশুর জন্য গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় একটি সুস্থ পরিবেশ থেকে। এই বঞ্চনা অবশ্য তাঁর শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করার পরও ছিল। ইয়ামামোতোর বয়স যখন সাত বছর, তখন তাঁর মা–বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সে সময় বালক ইয়ামামোতোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় একটি অনাথাশ্রমে। জাপানজুড়ে তখনো অভাবের কালো ছায়া। সংগত কারণে অনাথাশ্রমের অবস্থা ছিল আসলেই করুণ। ফলে জীবনের আরও একটু স্বাভাবিক নিশ্চয়তা পাওয়ার আশায় তিন ও পাঁচ বছর বয়সী ছোট দুই ভাইয়ের হাত ধরে ইয়ামামোতো ছুটে গিয়েছিলেন ইয়োকোহামা থেকে টোকিও। পরে সেখান থেকে শিকোকু দ্বীপের কোচি শহরে। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করে পরে একসময় তিনি বলেছিলেন যে সুখের একটি সংসারের জন্য তিনি ছিলেন কাঙাল। সন্ধ্যার ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় বাইরের বাড়িঘরের জানালা আলোকিত দেখে হিংসায় তাঁর কান্না পেত। দুঃখের এই স্মৃতি তিনি কখনো ভুলে যেতে পারেননি।

পরবর্তীকালে টুকটাক কাজ করে যাওয়া অবস্থায় স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শিখতেও শুরু করেন। আদতে বলা যায়, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের বেলায় তিনি অনেকটাই যেন স্বশিক্ষিত, যদিও প্রকৌশলীর শিক্ষা আনুপাতিক রেখা ও কাটছাঁট করার দিকগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করে নিতে তাঁকে সাহায্য করেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন কাজ করেছেন জাপানের পরিচিত ফ্যাশন ডিজাইনার জুঙ্কো কোশিনোর সহকারী হিসেবে। পেশাটিকে পুরোপুরি আয়ত্ত করে নেওয়া সেখান থেকেই। এরপর সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে ২৮ বছর বয়সে গড়ে তোলেন নিজের কোম্পানি। প্রায় একই সময়ে লন্ডনে নিজের ডিজাইনের পোশাকের একটি ফ্যাশন শো আয়োজন করার মধ্যে দিয়ে ফ্যাশন ডিজাইনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর প্রবেশ এবং এরপর থেকে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

পোশাকে বর্ণাঢ্য রঙের ব্যবহারের পাশাপাশি নকশায় ফুটে ওঠা জাপানি মোটিফ সেবার সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। সেই সূত্রে বিলেতের পপসংগীতজগতের নেতৃস্থানীয় কিছু তারকার সংস্পর্শে তাঁর আসা, যাঁরা চাইছিলেন ইয়ামামোতো যেন মঞ্চ উপস্থাপনায় সংগীত পরিবেশনের সময় দর্শকদের মধ্যে চমক সৃষ্টি করতে পারবে, সে রকম পোশাকের নকশা তিনি করেন। সেই যোগাযোগ কানসাই ইয়ামামোতোর জন্য নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ারই কেবল খুলে দেয়নি, একই সঙ্গে পপসংগীতের নামী কিছু তারকার সঙ্গে গড়ে দিয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের সূচনা। সেই দলে এলটন জন, স্টিভি ওয়ান্ডার ও ডেভিড বোওইয়ের মতো শিল্পীরা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এই শেষোক্ত সংগীতশিল্পীর জন্য নকশা করা কিছু পোশাক শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে আজও চিহ্নিত হচ্ছে। সে রকম একটি পোশাক হচ্ছে সাদা–কালো রঙের জাম্প স্যুট ধরনের, যেখানে পায়ের অংশ ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়ায় সবটা নিয়ে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক মনমাতানো আমেজ, যা কিনা শিল্পীর মঞ্চ উপস্থাপনায় নিয়ে এসেছিল নতুন চমক।

ইয়ামামোতো বিভিন্ন দেশে তাঁর ডিজাইনে তৈরি পোশাকের যেসব ফ্যাশন শোর আয়োজন করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী একটি ছিল ১৯৯৩ সালে মস্কোর রেড স্কয়ারে আয়োজিত সুপার শো। সংযমের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া চাকচিক্য এতে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। শৈশবের বঞ্চনা আর সুখের সংসারের জন্য হাহাকার সম্ভবত পরবর্তী জীবনে ইয়ামামোতোকে নিয়ে গেছে চাকচিক্যের এক জগতে, যা কেবল তার সেই দুঃখভরা অতীতকেই ভুলিয়ে দেয়নি, একই সঙ্গে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে দেশ–বিদেশে নতুন অনেক বন্ধু। শিল্পী ডেভিড বোওইয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব যেমন টিকে ছিল ২০১৬ সালে বোওইয়ের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। আর লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইয়ামামোতো সক্রিয় থেকেছেন নতুন ডিজাইনের পোশাক তৈরি করা নিয়ে। তিনি নিজেই যেমন একসময় বলেছিলেন, মানুষ সব সময় মৌলিক কিছু একটার খোঁজে থাকে, কেননা, এটাই তো হচ্ছে ভবিষ্যৎ। শৈশবে পরিবারের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ছিলেন প্রিয়জনদের অনেকে। পিতার মৃত্যুর পর কন্যা মিরাই ইয়ামামোতো ইনস্টাগ্রাম বার্তায় উল্লেখ করেছেন, ‘ভালোবাসার মানুষজন পরিবেষ্টিত হয়ে শান্তির সঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তিনি।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here