Home বাংলা নিউজ রপ্তানি পোশাকে বৈচিত্র্য আসছে

রপ্তানি পোশাকে বৈচিত্র্য আসছে

শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট এ রকম সাধারণ ব্যবহার্য আইটেমের বাইরে হরেক রকম ও ধরনের পোশাকের চাহিদা আছে। বিশ্ববাজারের এই চাহিদা বুঝে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বৈচিত্র্যময় পোশাক পণ্যের বাজারে ধীরে ধীরে ঢুকছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন আবু হেনা মুহিব

রপ্তানি তালিকায় তৈরি পোশাকের আইটেমের সংখ্যা এখন ৭০০-এর মতো। এর মধ্যে পাঁচটি আইটেম থেকেই আসে এ খাতের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় টি-শার্ট। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ট্রাউজার, সোয়েটার, সাধারণ জ্যাকেট ও শার্ট। দীর্ঘদিন এই বলয়ে আটকে আছে দেশের প্রধান এই রপ্তানি খাত। এর বাইরে তৈরি পোশাকের কয়েকটি পণ্য সম্ভাবনাময় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে। অনেক চড়াই-উতরাই শেষে সেই সম্ভাবনা এখন অনেকটাই বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে বৈচিত্র্য এনে দিচ্ছে- এমন কয়েকটি পণ্যের মধ্যে অ্যাকটিভ ওয়্যার, প্যাডেড জ্যাকেট, ফরমাল ওয়্যার এবং স্যুটের নাম প্রথমেই আসবে। এসব পণ্যের মধ্যেও আবার বৈচিত্র্য আছে। যেমন- অ্যাকটিভ ওয়্যার ক্যাটাগরিতে রয়েছে শত রকমের জার্সি। নানা ধরনের হোম টেক্সটাইল পণ্যের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের আইটেম।

অর্থাৎ, পোশাক খাতে পাঁচ পণ্যের নিরঙ্কুশ আধিপত্য অনেকদিন ধরে থাকবে- এমনটি আর বলা যাচ্ছে না। পঞ্চপান্ডবের বলয় ইতোমধ্যেই ভাঙতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে নতুন পণ্য হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে- এ রকম পণ্যও এখন উৎপাদন ও রপ্তানি করে বাংলাদেশ। পোশাকে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তাদের যুক্তি, প্রচলিত পণ্যের বাইরে থেকে উঠে আসা নতুন পণ্যগুলোর দর-দাম বেশি। কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বা তারও বেশি।

টি-শার্ট, পলো শার্ট, ট্রাউজার উৎপাদন ও রপ্তানির মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের। এরপর যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু পণ্য। এসব পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমেই এগিয়েছে পোশাক খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরেও মোট পোশাক রপ্তানিতে পাঁচটি পণ্যের অংশ ৭৩ শতাংশ। বাকি ৭০০ পণ্যের অংশ মাত্র ২৭ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শীর্ষ ১০ এর মধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ফুল ওভারস আইটেম। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ পণ্যে রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো।

শীর্ষ দশে ফুলওভার্স: গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ ১০ পণ্যের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে আছে ম্যানমেইড জার্সি এবং ফুলওভার্স। শীতে উষ্ণতা দেয়- এ রকম বস্ত্রে তৈরি পোশাককে ফুলওভার্স বলা হয়। সাধারণত বিভিন্ন পশুর লোমে তৈরি হয় ফুলওভার্স। ম্যানমেইড ফাইবারেও তৈরি হয় শত রকমের ফুলওভার্স আইটেম। ফুলওভার্সের সব আইটেমই সাধারণত সারা শরীর ঢেকে রাখে। অর্থাৎ একেকটি ফুলওভার্স পণ্যে কাপড়ের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি। সাধারণ পোশাকের তুলনায় দাম এ কারণে বেশি। গত অর্থবছরে ১৩০ কোটি ডলারের জার্সি এবং ফুলওভার্স রপ্তানি হয়েছে।

জ্যাকেটে দাম পাওয়া যায় কয়েকগুণ: এক সময় শুধু শীত থেকে সুরক্ষায় জ্যাকেট ব্যবহার হতো। কয়েক বছর ধরে ফ্যাশন প্রবাহেও বড় জায়গা করে নিয়েছে জ্যাকেট। এ প্রবাহে শত রকমের আইটেম যুক্ত হয়েছে জ্যাকেট পরিবারে। ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে বেশি কদর কুড়াচ্ছে- এ রকম উল্লেখযোগ্য জ্যাকেটের মধ্যে রয়েছে বোম্বার জ্যাকেট, টাক্সিডো, ট্যান্স কোর্ট, পারকা, পিকোর্ট, বলিরো ইত্যাদি। এসব জ্যাকেটের কাঁচামালের কোনোটি চামড়া, কোনোটি কৃত্রিম চামড়া, কোনোটি পশম আবার কোনোটি ডেনিম। এসব ক্যাটাগরির মধ্যে আছে আরও অনেক ধরনের জ্যাকেট। সাধারণ পোশাকের তুলনায় একেকটি জ্যাকেটের দাম কয়েকগুণ বেশি। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশও নতুন ধরনের জ্যাকেট রপ্তানি শুরু করেছে।

জ্যাকেটের বিশ্ববাজার এখন বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৩৭০ কোটি ডলারের জ্যাকেট রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৫০ কোটি ডলার। টিম গ্রুপের ফোর-এ ইয়ার্ন ডায়িং থেকেই রপ্তানি হয়েছে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলারের জ্যাকেট। এ বছর প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে পাঁচ কোটি ডলার। আগামী বছর জ্যাকেট রপ্তানি দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফ্লিস জ্যাকেট রপ্তানি করে ফতুল্লা গ্রুপ। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম ফজলে এহসান সমকালকে বলেন, কয়েক বছর ধরেই এ ধরনের জ্যাকেট উৎপাদন ও রপ্তানি করছেন তারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জ্যাকেটের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বছরে প্রায় ১০ লাখ ডলারের জ্যাকেট রপ্তানি করছে তার প্রতিষ্ঠান।

অ্যাকটিভ ওয়্যারের শত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে: দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যাকটিভ ওয়্যারের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধির গতি বেশ ভালো। সাধারণ পরিধেয় বস্ত্রের বাইরে নির্দিষ্ট কাজের উপযোগী বিভিন্ন পোশাককে অ্যাকটিভ ওয়্যার বলা হয়। অ্যাকটিভ ওয়্যারের তালিকায় রয়েছে স্পোটর্স ওয়্যার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জার্সি ছাড়াও ব্যায়াম, জিম, ইয়োগা, সাইক্লিংয়ের জন্য পোশাক। তবে নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও এসব পোশাক স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করা যায়। অ্যাকটিভ ওয়্যারের মধ্যে সম্প্রতি বেশি আলোচনায় এসেছে সিমলেস গার্মেন্ট। বিশ্ববাজারে নিট ক্যাটাগরির নতুন একটি পণ্য এটি। কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশও এর উৎপাদন ও রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে। এখনও রপ্তানির পরিমাণ কম। তবে আগামীতে এর বড় সম্ভাবনার কথা বলছেন উদ্যোক্তারা।

স্যুটের রপ্তানি ১০ বছরে ১০ গুণ: দেশের তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানি আয়ের এক শতাংশের মতো আসে স্যুট ও ব্লেজার থেকে। দেশে ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান এখন স্যুট-ব্লেজার উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে। উচ্চমূল্যের এই পোশাক উৎপাদন শুরুর এক দশকের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণ। গত অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২০ কোটি ডলার। রপ্তানি আরও বাড়াতে প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তারা জানান, বিশেষ ধরনের মোল্ড বা ছাঁচে ব্লেজার উৎপাদন করতে হয়। এ ধরনের প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ টেকনিশিয়ান ও শ্রমিক প্রয়োজন। চীনা প্রযুক্তি ও টেকনিশিয়ানের সহায়তায় চলছে কয়েকটি কারখানা। স্যুট-ব্লেজারে ভালো ফিনিশিংয়ের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও থাকতে হয়। চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে ব্লেজার কারখানা স্থাপন করেছে নিউএজ গ্রুপ। ১০ জন চীনা টেকনিশিয়ানের সহায়তায় উৎপাদন শুরু হয় তাদের আশুলিয়ার একটি কারখানায়। গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম সমকালকে বলেন, কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানের ঘাটতি পূরণ করতে পারলে স্যুট-ব্লেজারে বাংলাদেশের বড় সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও মনোযোগ প্রয়োজন: নির্দিষ্ট কিছু রপ্তানি পণ্যের ওপর বেশি নির্ভরতায় ঝুঁকি থাকে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীরা এ নিয়ে বাংলাদেশকে অনেকদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাংলাদেশ ডেলিগেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকায় জোটের ২৮ দেশে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। তবে এ বিষয়টি অবশ্য গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে সরকার। বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে অন্যান্য পণ্যের মতো পোশাক খাতের মধ্যেও বৈচিত্র্য আসতে শুরু করেছে।

এ ক্ষেত্রে আরও অনেক সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল হক মুকুল সমকালকে বলেন, ফ্যাশন পণ্যের মধ্যে মেয়েদের বিভিন্ন আইটেমের লিঞ্জারি, ফাংশনাল আরএমজির মধ্যে নভোচারীদের পোশাক এবং বিভিন্ন ইকুইপমেন্টস উৎপাদনের সুযোগ আছে। বৈচিত্র্যময় পণ্যের যেসব আইটেমের পোশাক এখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়, সেগুলোর মধ্যেও অনেক উচ্চমূল্যের পোশাক রয়েছে। মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে সেসব পণ্যের উৎপাদনে যেতে হবে।

ফেব্রিক্সই বড় সমস্যা: বিভিন্ন ক্যাটাগরির বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে এখনও প্রধান সমস্যা হচ্ছে মানসম্পন্ন ফেব্রিক্স দেশে উৎপাদন না হওয়া। পোশাকের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে স্থানীয় বস্ত্রের মান এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এ কারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ দামি আইটেম করা খুব সহজ কাজ নয়। এ ব্যাপারে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ সমকালকে বলেন, মানে উন্নত পোশাকের একটা বড় অংশই হচ্ছে কাপড় বা ফেব্রিক্স। মিহি সুতার নিখুঁত কাপড় না হলে দামি পোশাক হয় না। এখানে অনেক বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। স্থানীয় বিনিয়োগে এ সমস্যার সহজ কোনো সমাধান নেই। বস্ত্র খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শতভাগ বিদেশি কিংবা যৌথ বিনিয়োগে বস্ত্র খাত উন্নয়নে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

বৈচিত্র্য বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপ: পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে বাজার সম্প্রসারণ, বিপণন নেটওয়ার্কে সহযোগিতা দেওয়া ও অবকাঠামো অসুবিধা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে যাতে কাঁচামাল সহজে পাওয়া যায়, সে জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইপিবির পণ্য উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহজালাল সমকালকে জানান, তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিযোগ্য সব পণ্যের সম্ভাবনা এবং সমস্যা চিহ্নিত করতে একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here